‘এ জীবন লইয়া কী করিব?’ আর্তস্বরে নিজেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঠিক করেছিলেন শেষমেষ যে, ঈশ্বরেই নিজেকে সমর্পন করা ভালো। অবশ্য, এটি নতুন কিছু নয়, বাঙালি মাত্রই শেষ জীবনে জীবনকে ঈশ্বরের পদপ্রান্তে দাখিল করে, একই সঙ্গে চুরিচামারি লুচ্চামি চালিয়ে যায়। ড. কামাল হোসেন, হ্যাঁ সেই বিখ্যাত ড. কামাল হোসেন, মিডিয়ার জোরে যাকে বাংলাদেশের সংবিধানের রচয়িতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেই ড. হোসেন খুব সম্ভব বঙ্কিম পড়েন নি। আমাদের প্রশ্ন এ জীবন লইয়া ড. কামাল হোসেন কী করিলেন, এ জীবন বিএনপি-জামায়াত বা খুনিদের জন্য উৎসর্গ করিলেন।
এরশাদ আমলে যখন বাংলাদেশকে সব সম্ভবের দেশ বলে আখ্যায়িত করেছিলাম তখন অনেকের জাতীয়তাবাদী চেতনায় খারাপ লেগেছিল। আজ কি মনে হয় না, কথাটির যৌক্তিকতা আছে?
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা একটি বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন তা’হলো- সংবিধানের ‘পবিত্রতা’। সংবিধান খুব প্রয়োজন না হলে কেউ মানেন না, কামাল হোসেন কতোটা মানেন? সংবিধানে বিশ্বাস করলে সংবিধান হন্তারকদের সঙ্গে হাত মেলানো যায় না।
নির্বাচনের ঘণ্টা বেজেছে। এর আগে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দরবার করতে চেয়েছেন সংবিধানকে সমুন্নত রাখার জন্য। এবং এখন নির্বাচন কমিশনের কাছে বারবার ‘সাংবিধানিক দাবি’ তোলা হচ্ছে। আমাদের মতো অনেকে যারা পদাধিকার বলে বুদ্ধিজীবী তারা মনে করেন, বিএনপির সাংবিধানিক দাবি ও অধিকার সরকার অগ্রাহ্য করছে। কিন্তু, আমরা ভুলে যাই আওয়ামী লীগ যদি সংবিধান করে থাকে সে সংবিধান নষ্ট করেছিল বিএনপি।
শেখ হাসিনা কেন সংলাপে রাজি হলেন তার ১০১টি কারণ থাকতে পারে। এই ১০১টি কারণের মধ্যে একটি হতে পারে, খালেদা জিয়া ও তার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান যারা খুন করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনাকে, সেই খুনিদের মুখোমুখি হাসিমুখে আলাপ করা মুশকিল। কামাল হোসেন এখন ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
কামাল হোসেনকে তিনি চাচা বলে এখনও সম্মান করেন। সেই চাচা দলের কর্তৃত্ব না পেয়ে চলে গেছেন বটে কিন্তু খুনিদের সঙ্গে সরাসরি হাত মেলান নি। বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে তিনি থাকবেন না। ‘গণতান্ত্রিক’ কারণে তিনি ঐক্যফ্রন্টের নেতা হয়েছেন। মির্জা ফখরুলদের নেতৃত্বের চেয়ে কামাল হোসেনের নেতৃত্ব শ্রেয় মনে হয়েছে।
ফ্রন্টের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি, সবচেয়ে ছোট দল গণফোরাম। ছোট দলের বড় নেতা এখন বড় দলের বড় নেতা। ড. কামাল হোসেন থাকলে মির্জা ফখরুলরা হারিয়ে যান। কামাল হোসেনকে বিএনপি এখন ছাড়তে পারবে না। কারণ, খালেদা জিয়া ও তারেক এখন দলের নেতৃত্ব দিতে পারবেন না হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী। তারেক ও খালেদার নেতৃত্ব বিএনপিকে একটি সন্ত্রাসীগ্রুপে পরিণত করেছিল। কানাডার আদালত এই দলটিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণা করেছে।
ভাগ্যের পরিহাস বলে বাংলায় একটি কথা আছে। ড. কামাল হোসেনকে দেখে তাই মনে হচ্ছে। ছিলেন নামকরা আইনবিদ, বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র, ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান। বাই চান্স আওয়ামী লীগের নেতা। বাইরে তার প্রগতিশীল চেহারার আড়ালে যে একটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বিদ্যমান তা বোঝা যায় নি। তিনি বিএনপির ‘গণতন্ত্রের’ জন্য লড়াইয়ে নেমেছেন। এই বিএনপির নেতৃবৃন্দ ক্ষমতায় থাকাকালীন রাষ্ট্রীয়ভাবে বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। খুনীদের সঙ্গে বিএনপির সবসময় একটি আঁতাত আছে। বঙ্গবন্ধু খুনের সঙ্গে জিয়া অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত। চার নেতা ও সেনাবাহিনীর শত শত সৈন্যের মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে জিয়া জড়িত। ১৯৭১ সালে যারা ৩০ লাখ খুন করেছিল, পাঁচ লাখের বেশি ধর্ষণ করেছিল, তাদের বন্ধুরূপে ঘোষণা করেছিলেন জিয়া। খালেদার আমলে বহু হিন্দুকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। খুন খারাবি করে ওই দলের নেতারা বিখ্যাত হয়েছেন। মেজর হাফিজ ভোলায় হিন্দু ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর যে সন্ত্রাস চালিয়েছিলেন, তা ১৯৭১ সালের অনেক ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়। দলের সাবসিডিয়ারি হিসেবে জঙ্গিদের পালন করেছেন খালেদা। তারপর শেখ হাসিনাকে খুন করতে চেয়েছেন। মানবতা বিরোধী অপরাধকে সমর্থন করেছেন। এরকম একটি দলকে টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ড. কামাল ও সুশীলরা গণতন্ত্রের নামে। অথচ এ দলের রাজনীতিই নিষিদ্ধ করা উচিত। তাদের ছাড়া নির্বাচনকে গণতন্ত্রহীন নির্বাচন মনে করেন তারা। অথচ সভ্য দেশে গণতন্ত্রকে নিরাপদ রাখার জন্য এদের বাইরে রাখা হয়, যেমন নাজি বা ফ্যাসিস্টদের। ঈশ্বর এদের বাঙালি করেছেন, মানুষ করেন নি।
দুই.
ঐক্যফ্রন্ট যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী তখন প্রস্তাব গ্রহণ করে বলেছেন, সংলাপ হবে তবে ‘সংবিধান সম্মত সব বিষয়ে’। খালেদা জিয়া যদি জেলে না থাকতেন তাহলে তিনিই হতেন ঐক্যফ্রন্টের প্রধান। জেলে যাওয়ার আগে তিনিও বলতেন, সরকার চাইলেই সংবিধান সংশোধন করে তাদের দাবি মানতে পারে। এখন খালেদা জিয়া জেলে, তার জায়গায় ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্টের প্রধান। এই ঐক্যফ্রন্টে বিএনপিই প্রধান দল কিন্তু তারাও ড. কামালের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। কামাল হোসেনও প্রায় একই সুরে বলেছেন, সরকার চাইলে এক মিনিটেই সংবিধান সংক্রান্ত সমস্ত ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতে পারেন। সংবিধান ছাড়া কারো চলে না এবং সময় সুযোগ পেলে দল বা নিজের স্বার্থে সবাই সংবিধান ব্যবহার করতে চান।
৪ নভেম্বর যখন [১৯৭২] সংবিধান গৃহীত হয় তখন বঙ্গবন্ধু সংসদে বলেছিলেন, ‘আজ প্রথম সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে। বাংলার ইতিহাসে বোধহয় এই প্রথম নজির যে, বাঙালিরা তাদের নিজেদের শাসনতন্ত্র প্রদান করছে। বোধ হয় না, সত্যিই প্রথম- বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে গণপরিষদে এসে তাদের দেশের শাসনতন্ত্র প্রদান করছে।‘
এ মন্তব্য সত্য। বক্তব্য শেষে তিনি বলেছিলেন, ‘এই শাসনতন্ত্রের জন্য কতো সংগ্রাম হয়েছে এই দেশে। আজকে আমার দল যে ওয়াদা করেছিল তার এক অংশ পালন করা, কিন্তু জনতার শাসনতন্ত্রে কোন কিছু লেখা হয় না। তারা এটা গ্রহণ না করলে প্রবর্তন করা হবে না, ব্যবহার না করলে হবে না। ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম-নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক, শহীদের রক্তদান সার্থক।‘
বাঙালি সংবিধান করেছিল, সে জন্য তা প্রবর্তিত হয়েছিল এবং সে সংবিধান অনুসারে দেশ চলবে তাই চেয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর আমলেও চারবার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। এর মধ্যে চতুর্থটি ছিল বিতর্কিত ও সমালোচিত। ১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারি সে সংশোধনী পাস হয়। এই সংশোধনী মোতাবেক দেশে একদলীয় শাসন ও রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি সরকার চালু করা হয়েছিল। যেকোনও কারণেই বঙ্গবন্ধু এই সংশোধনী করে থাকুন না কেন। এর পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো কঠিন ছিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার অজুহাত ছিল সংশোধনী। তবে, এই সংশোধনীর পক্ষে বঙ্গবন্ধু যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাতে কারণগুলি উল্লেখ করা হয়েছিল। মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। সুতরাং, তৎকালীন অবস্থায় তা সংশোধনের জোরালো কারণ ছিল। লক্ষ্যণীয়, বঙ্গবন্ধু কিন্তু যে দল গড়েছিলেন, সে দল বিলুপ্ত করেছিলেন। এটি ছিল চরম আত্মত্যাগ। তার পরে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরা কিন্তু সংবিধান স্থগিত করেছেন, প্রচুর সংশোধন করেছেন নিজ স্বার্থে এবং নিজেরা দল গড়েছিলেন। দেশের স্বার্থে দল বিলুপ্ত করেন নি।
আরেকটি বিষয় প্রাসঙ্গিক। চতুর্থ সংশোধনী এতো খারাপ হলে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত কেন জিয়া বা এরশাদ চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করেন নি। সেই আওয়ামী লীগের উদ্যোগেই কিন্তু আগের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে সংসদীয় পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, চতুর্থ সংশোধনী যখন পাশ হয় তখন ড. কামাল হোসেন সংসদ সদস্য এবং এই সংশোধনীতে তিনি আপত্তি করেন নি।
তখনই সংবিধান সংশোধিত হয়েছে তখনই সরকার প্রধান বলেছেন, জনস্বার্থেই তা বদল করা হয়েছে। চর্তুদশ সংশোধনী পাসের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘বিএনপি সরকারই জনগণের স্বার্থে সংবিধানের দ্বাদশ, ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ সংবিধান সংশোধন বিল পাশ করেছে। এ বিল পাসের পর নারী আসন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। এ বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। আমরা নারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে কথা বলেই প্রয়োজনীয় প্রস্তাব এনেছি’, [ভোরের কাগজ ১৮.৫.২০০৪]। লক্ষ্যণীয় ‘জনস্বার্থ’ শব্দটি যেটি এর আগে এরশাদও ব্যবহার করেছেন।
জনস্বার্থে কি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বা জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদ কি সংবিধান সংশোধন করেছিলেন? মোটেই না। বা জিয়াউর রহমানের উত্তরসুরি খালেদা জিয়া? চতুর্দশ সংশোধনী করা হয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের স্বার্থে এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি টাঙানোর জন্য। সে প্রসঙ্গে পরে আসব। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি বা জামায়াত [বিএনপি যার সঙ্গে প্রকাশ্যেই গাঁটছড়া বেঁধেছে] কখনও জনস্বার্থ দেখেনি, নিজ স্বার্থ দেখেছে এবং আজ তারা যে সংশোধনী আনতে চাচ্ছে তা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’, তা যে ফর্মেই হোক।
‘সংবিধানপ্রেমী’ ঐক্যফ্রন্টের নিশ্চয় জানা আছে ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনার জন্য যে ৩৪ জন গণপরিষদ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল সেখানে যারা বাংলাদেশ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই চার নেতা থাকা সত্ত্বেও কনিষ্ঠ ড. কামাল হোসেনকেই সভাপতি করা হয়েছিল। আজ ড. কামাল যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যে ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান [ও খন্দকার মোশতাক] ও আজকের বিরোধীদল আরেক সংবিধানপ্রেমী জেনারেল এরশাদের সময় দু’বার সংবিধান স্থগিত করা হয়েছিল। ২০ অগাস্ট ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল অর্থাৎ চার বছর এবং ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ চার বছর, বলা যেতে পারে এই আট বছর সংবিধান স্থগিত ছিল। আজ যারা সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন ওই আট বছর তারা সংবিধান স্থগিত করেছিলেন।
তিন
এসব কথা আমরা মনে রাখি না। ৪৬ বছরে আমাদের সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে সতের বার এবং অধিকাংশই ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে। ব্যতিক্রম দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ। বঙ্গবন্ধুর আমলে চারটি সংশোধন করা হয়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংশোধন করা হয় যথাক্রমে ১৫ জুলাই ১৯৭৩, ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ এবং ২৮ নভেম্বর ১৯৭৪। সদ্য স্বাধীন দেশে আইনের ক্ষেত্রে কিছু সামঞ্জস্য বিধানের জন্য সংশোধনীগুলো আনা হয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ আমলে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি যে চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়, সেটিই সবচাইতে বিতর্কিত এবং সমালোচিত যা আগে উল্লেখ করেছি।
আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করতে হলে আওয়ামী-বিরোধী, বিশেষ করে বিএনপি বারবার চতুর্থ সংশোধনীর কথা বলে; কিন্তু জিয়াউর রহমান যে পঞ্চম সংশোধনী এনেছিলেন, সে বিষয়ে কিন্তু সবাই নিশ্চুপ। বঙ্গবন্ধু তো তবু সংসদে আলোচনা করে সংশোধনীটি পাস করিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান তার যাবতীয় অবৈধ কার্যকলাপ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে করেছিলেন। আমরা যেহেতু পূর্ব ইতিহাস ভুলে যাই, সেহেতু ইচ্ছেমতো যখন যা মনে আসে তা বলি। কিন্তু পূর্ব ইতিহাস জানা থাকলে যা-তা মন্তব্য করা যায় না।
জিয়াউর রহমান কীভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সে ইতিহাস সবার জানা। সেটি বলে বিএনপিকে আর বিব্রত করতে চাই না। ক্ষমতায় গিয়ে নিরস্ত্র জনগণ ও রাজনীতিবিদদের দিকে বন্দুক তাক করে রাজা-বাদশাহর মতো তিনি একটির পর একটি ফরমান জারি করেছিলেন। এর সবগুলোই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তিতে আঘাত হেনেছিলো এবং এসব ফরমান সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল একটি মৌল বৈশিষ্ট্য। পাকিস্তানপন্থিদের কাছে স্বভাবতই তা ছিল উষ্মার বিষয়। তাই দেখি, শেখ মুজিবকে হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রেডিও পাকিস্তান ঘোষণা করলো, বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে নীতি হিসেবে বর্জন করা হয়েছে। রেডিও পাকিস্তান এ ঘোষণা দিয়েছিল কি-না, পরে অবশ্য তা বিতর্কের বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে এক সামরিক ফরমান অনুযায়ী শাসনতন্ত্রের ৬৬ অনুচ্ছেদের একটি উপধারা ও ১২২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হলো, যার ফলে পাকিস্তানি দালালরা পেল ভোটার হওয়ার সুযোগ। আগে এতে আইনগত বাঁধা ছিল। ৩৮ অনুচ্ছেদে সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের মে মাসে এক সামরিক ফরমান জারি করে তা বাতিল করা হলো। ফলে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু হলো, যার ঝোঁক ছিল পাকিস্তানের দিকে।
জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি দালালদের তোষণ করতে চেয়েছিলেন, যাতে তার সমর্থকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। নিজের ক্ষমতা সংহত ও বৃদ্ধিই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য, সিভিল সমাজ নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না।
জিয়াউর রহমানের অধীনে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: ভঙ্গিতে গণতন্ত্র, প্রয়োগে নির্মম স্বৈরাচার। যেমন, ২১ জুলাই ১৯৭৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরের ফাঁসি। বিদ্যমান আইনে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল, তার ভিত্তিতে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়া যায় না। শুধু তা-ই নয়, পঙ্গু ব্যক্তিকেও ফাঁসি দেয়া যায় না। সুতরাং তাহেরের মৃত্যুর ১০ দিন পর একটি ফরমান জারি হলো। এর মূল বক্তব্য ছিল সামরিক বাহিনীতে কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করলে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। ২৮ জুলাই ১৯৭৬ সালে, অর্থাৎ তাহেরের ফাঁসির এক সপ্তাহ পর জিয়া একটি গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নেয়ার কথা ঘোষণা করলেন কৌশল হিসেবে। এ ফরমান ছিল রাজনৈতিক দলবিধির ফরমান। এভাবে গণতান্ত্রিক ভঙ্গি নিয়ে স্বৈরাচারের মিশ্রণ ছিল জেনারেল জিয়ার শাসনামলের বৈশিষ্ট্য।
জিয়ার এই ফরমানটির কথা বারবার বিএনপি উল্লেখ করে বলে যে, তিনি একদলীয় শাসনের বদলে বহুদলীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। ক্ষমতা দখলের জন্য একজন সামরিক শাসক উদগ্রীব থাকতে পারেন; কিন্তু উৎখাতকারীরূপে তিনি পরিচিতি হতে নারাজ। রাজনৈতিক দলগুলো থেকে তিনি সবসময় হুমকি আশঙ্কা করেন বটে। কিন্তু যদি রাজনৈতিক দল না থাকে তাহলে তিনি বিবেচিত হন উৎখাতকারী রূপে। সুতরাং সামরিক শাসক সবসময় আশা করে রাজনৈতিক দলগুলো থাকবে, কিন্তু কাজ করবে সরকারি বিধিনিষেধ মেনে। জিয়াউর রহমান ঠিক ওই কাজটি করেছেন। রাজনৈতিক দলবিধি অনুসারে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো কাজ করতে পারবে জিয়া সরকার থেকে লাইসেন্স নিয়ে। রাজনৈতিক দলগুলোকে রেজিস্ট্রি করতে হবে। সরকারের সামনে দল সম্পর্কিত যাবতীয় নথিপত্র, উদ্দেশ্য, ফান্ড, গঠনতন্ত্র, সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যাবলী এবং সেগুলো কার্যে পরিণত করার আইনগত বিধি সবকিছু দাখিল করতে হবে। এগুলো পাওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, তিন সপ্তাহ পর সরকার আবেদনকারী দলকে জানাবে যে, দল বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে কী পারবে না।
১৯৭৬ সালে এ দলবিধি ঘোষণা করার পর সরকার প্রায় শ খানেক আবেদনপত্র পায় এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রায় পঞ্চাশটিকে ছাড়পত্র দেয়। সামরিক শাসন তখনো বলবৎ। সুতরাং দলগুলোকে ঘরোয়া রাজনীতি করার অনুমতি দেয়া হয়। এটিকে যদি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন বলা হয়, তাহলে বলার কিছু থাকে না। নিরস্ত্র রাজনীতিবিদরা বন্দুকের মুখে সেই ঘরোয়া রাজনীতি বা ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, যখন বাকশাল গঠিত হয় তখন তিনটি দল নিয়েই তা গঠিত হয়েছিল এবং অনেক দলহীন ব্যক্তিও এতে যোগ দিয়েছিলেন। সুতরাং কোন অর্থে তা একদলীয়?
পাকিস্তানপন্থিদের দলে ভিড়ানোর জন্য এপ্রিল ১৯৭৭ সালে তিনি ফরমান জারি করে ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রের বেশকিছু মূল ধারা ও বৈশিষ্ট্য বদল করলেন। সিভিল সমাজের ওপর এটিই ছিল জিয়ার পরিকল্পিত প্রথম হামলা।
শাসনতন্ত্র সংশোধনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘গণমনে অসন্তোষ’; এই ‘গণ’ বা ‘জন’রা ছিলো স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী, নিম্নরূপ:
১. শাসনতন্ত্রের ৬ ধারায় বাংলাদেশের নাগরিকদের উল্লেখ করা হয়েছিল বাঙালি হিসেবে। এই ধারা সংশোধন করে বাঙালিকে করা হলো বাংলাদেশী। কিন্তু বাংলাদেশীদের জাতীয় সত্তা স্পষ্ট করে তোলার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯ ধারায় সুস্পষ্টভাবে তার উল্লেখ ছিল। এতে পাকিস্তানপন্থীরা খুশি হলো এই ভেবে যে, জাতিসত্তা আবার দ্বিখ-িত হলো এখন বাংলাদেশের বাঙালি ও ভারতীয় বাঙালি আলাদাভাবে চিহ্নিত হলো।
২. সংবিধানের শিরোনামের নিচে যুক্ত হলো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’।
৩. সংবিধানের প্রস্তাবের শুরুতে ‘জাতীয় মুক্তির জন্যে ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ পরিবর্তে যুক্ত হলো ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের’।
৪. ৮ ধারায় ছিল ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’। এর পরিবর্তে যুক্ত হলোঃ ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার।’
৫. ২৫ ধারায় একটি উপধারা সংযোজিত হলো : ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সুসংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’
৬. ৪২ ও ৪৭ ধারা সংশোধন। শেষোক্ত ধারা পাকিস্তানপন্থীদের সবচাইতে বেশি খুশি করেছিল। কারণ এতে রাষ্ট্রীয়করণনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সংসদ বাতিল করা যাবে বলে বলা হলো। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী এর জন্য প্রয়োজন ছিল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
এসব সংশোধনী পাকিস্তানবিরোধীদের এতো খুশি করেছিল যে, ‘বামপন্থী’ নেতা, বহু দলবদলকারী, বর্তমানে ‘চিনি জাফর’ হিসেবে খ্যাত কাজী জাফর আহমদের মতো লোক পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ‘মাওলানা সিদ্দিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করার যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন, তার সুযোগ সরকারই [জিয়া] করে দিয়েছেন। সংবিধানের ৩৮ ধারা বাতিলের ফলেই এরা রাজনীতিতে আসতে পেরেছে। এরা জাতি ও গণস্বার্থবিরোধী। সংবিধানের ৩৮ ধারা বাতিল করে এসব জাতীয় দুশমনকে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়া একটি অন্তবর্তীকালীন সরকারের উচিত হয়নি।‘
এ ধরনের অনেক ফরমান তিনি এবং খন্দকার মোশতাক জারি করেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের মতো সেখানে সামরিক বেসামরিক পাকিপন্থী আমলারা জিয়া বা বিএনপিকে সাহায্য করে। বিএনপি লাভ করে ২০৭টি আসন। কৌতুহলের বিষয় যে, যেসব সামরিক অফিসার বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন, তারা জয়লাভ করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের হয়ে যারা দাঁড়িয়েছিলেন, তারা পরাজিত হন। যেমন, মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান। তাকে প্রথমে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। পরে দেখা গেল তিনি পরাজিত।
এই সংসদে ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে পাস করা হয় পঞ্চম সংশোধনী। সেটি ছিল এরকম:
“১। সংক্ষিপ্ত শিরোনাম- এই আইন সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন, ১৯৭৯ নামে অভিহিত হইবে।
২। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের সংশোধন- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে, ১৭ অনুচ্ছেদের পর নিম্নবর্ণিত নূতন ১৮ অনুচ্ছেদ সংযোজিত হইবে:
১৮। ফরমানসমূহ, ইত্যাদির অনুমোদন ও সমর্থন। -১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ ও অন্যান্য আইন এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোনো ফরমান দ্বারা এই সংবিধানে যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা এবং অনুরূপ কোনো ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্য কোনো আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতাবলে, অথবা অনুরূপ কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া বা অনুরূপ বিবেচনায় কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোনো আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোনো দ-াদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশকৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ, অথবা প্রণীত, কৃত, বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল এবং তৎসম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”
অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার পর যেসব কুকর্ম করা হয়েছিল, সব জায়েজ করা হলো। এর মধ্যে হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি প্রধান। সেই বিএনপিই আবার সেনাবাহিনী ক্লিন হার্টে হেফাজতে ৫০ জনকে হত্যার জন্য দায়ীদের ইনডেমনিটি দিয়েছে। বিএনপি খুনিদের ভালোবাসে। কী আর করা!
চার.
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের বক্তৃতায় বলেছিলেন, “চারটা মূল স্তম্ভের উপর এই শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছে। এই সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা এই হাউসেই হয়েছে। আমার সহকর্মীরা অনেকেই এর উপর বক্তৃতা করেছেন। আমার সহকর্মী ড. কামাল হোসেনও অনেক কথার উত্তর দিয়েছেন। এই যে চারটা স্তম্ভের উপর শাসনতন্ত্র রচনা করা হলো এর মধ্যে জনগণের মৌলিক অধিকারই হচ্ছে মূল বিধি। মূল চারটা স্তম্ভ- জনগণ ভোটের মাধ্যমে এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ সংগ্রামে।”
রাষ্ট্রের মূলনীতি কখনও বদল করা যায় না। কিন্তু জিয়া করেছিলেন। এটি কি ড. কামাল সমর্থন করেন? এরশাদ ইসলাম নিয়ে যে কুকর্ম করেছিলেন ক্ষমতায় গেলে তা কামালের ঐক্যফ্রন্ট কি যে বদল করবে? শেখ হাসিনা এতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি ওই চারনীতি ফিরিয়ে এনেছেন কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করতে পারেন নি। এমনকি আদালত পর্যন্তও। এ সংশোধনীর বিরুদ্ধে যখন ড. কামাল হোসেনসহ অনেকে রিট করেছিলেন তখন আদালত আইনজীবী ও বিচারকদের স্বার্থে হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ বাতিল করেছিলেন কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করেন নি। আরো অনেক পরে যখন আবার এই প্রসঙ্গ এলো তা খারিজ করে দেয়া হলো। কার স্বার্থ কে রক্ষা করলো! শেখ হাসিনা যা পারেন নি তা কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্ট কি সেই সংশোধনী আনবে? যদি আনার অঙ্গীকার দেয় তখন আমরাও উচ্চকিত হতে পারি এ বলে যে, তাদের দাবি বিবেচনায় আনা হোক।
যে কাজটি বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত করেননি, জিয়াউর রহমান সে কাজটি করেছিলেন। সংবিধান বা রাষ্ট্রের মূল উপাদানসমূহ বদলে দিয়েছিলেন। একটি জাতি যে উপাদান গড়েছিল, একটি ব্যক্তি তা বিনষ্ট করেছে, আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে এমনটি প্রায় ঘটেনি। রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে তিনি তা সাম্প্রদায়িক করেছিলেন। পাকিপন্থিদের জন্য সুবিধা দিয়েছিলেন, যে কারণে পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তা ও জামায়াতিরা জিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। বিএনপির সঙ্গে এই দুই গ্র“পের যে গাঁটছড়া জিয়া বেঁধেছিলেন, বেগম জিয়া তা শুধু দৃঢ়ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশবিরোধী যাবতীয় দুষ্কর্ম এদের দ্বারাই সম্পন্ন করা হয়েছে। আরো উল্লেখ্য, চতুর্থ সংশোধনী খারাপ, জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছেন; কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন না কেন? সংসদীয় গণতন্ত্র না হলে বহুদলীয় গণতন্ত্র হয় কীভাবে? রাষ্ট্রপতির শাসন পদ্ধতি তিনি বদলালেন না কেন?
১৯৮১ সালের ১০ জুলাই বিএনপি ষষ্ঠ সংশোধনী করেছিল, যাতে বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি হতে পারেন।
এরশাদই একমাত্র শাসক, যিনি সংবিধানকে বিতর্কিত করে তুলে তারই ওপর ভিত্তি করে নিজের বৈধতা অর্জন করতে চেয়েছেন। তার আমলে সংবিধানের এতো অদল-বদল করা হয়েছে যে, সংবিধানের মূল চরিত্রটিই পাল্টে গেছে। তিনি একই সঙ্গে সাংবিধানিক ভিত্তি চেয়েছেন নিজের বৈধতার জন্য অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন যা সন্নিবিষ্ট হয়েছিল সংবিধানে, তা বিনষ্ট করতে চেয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সংবিধান বা আইন ছাড়া তিনি চলেন না। কিন্তু মূল বিষয়টি ছিল সংবিধানকে সামনে রেখে এর মূল চরিত্রটি পাল্টে ফেলা এবং এর সঙ্গে যুক্ত ইনস্টিটিউশনসমূহ সম্পর্কে জনগণের আস্থা বা বিশ্বাস নষ্ট করে ফেলা। যেমন, নির্বাচন, পার্লামেন্ট, সংসদ সদস্য, মন্ত্রিসভা প্রভৃতি। গত এক দশকে যে তিনি এ কাজে অনেকটা সফল হয়েছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে প্রয়োজনে সংবিধান মেনে চলার জন্য বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, এরশাদ যতবারই অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান বদল করেছেন, ততবারই এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনজীবীরা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন ড. কামাল হোসেন, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, শামসুল হক চৌধুরী, গাজীউল হক, আমীরুল ইসলাম প্রমুখ আইনজীবীর নেতৃত্বে। তাদের সমর্থনে সবসময় এগিয়ে এসেছেন মধ্যবর্তী কারকদের অন্যান্য অংশ এবং প্রাথমিক কারকরা।
এরশাদ নিজ লক্ষ্য ঠিক রেখে এর মোকাবিলা করতে চেয়েছেন দু’ভাবে। এক. তার আজ্ঞানুসারী বিচারক নিয়োগ করা ও আইনজীবীদের মধ্যে নিজের সমর্থক তৈরি করা। কিন্তু প্রতিরোধের তোড়ে তা ভেসে গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, যাকে এরশাদ অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন, যে মন্তব্য করেছিলেন তা-ই ছিল সিভিল সমাজের মনোভাব :
‘যিনি আইনের স্রষ্টা তাঁকেও নিজের আইন মেনে চলতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ’৭২ সালের সরকারের বৈধতার প্রশ্নটি তুলে সামরিক আইন বলবৎ থাকা অবস্থায তার নিজের জারিকৃত ঘোষণাপত্রকেও লঙ্ঘন করেছেন। …১৯৭২ সাল থেকে সংসদ কর্তৃক স্বীকৃত যে সংবিধান ’৮২ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্যে কার্যকর ছিল, এই সামরিক সরকার যা মেনে নিয়েই স্থগিত রেখেছেন, তাই এই সংবিধানের প্রণেতাদের নিয়ে আজ বিতর্কের প্রশ্নই ওঠে না।…’
পৃথিবীর সব দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর কতগুলো মৌলিক তথ্য থাকে, যা সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, স্বাধীনতার বিকাশ- এ বিষয়গুলো সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এর ওপর কেউ কিছু বলতে পারেন না। কিছু বলার অধিকারও নেই।
লক্ষণীয় যে, বিচারালয় ও বিচারকদের নিয়ে এরশাদ যা করেছিলেন মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে, বিএনপি-জামায়াতিরা ঠিক একই কাজটি করেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, জাতীয় পার্টি ও বিএনপিতে থেকে মওদুদ আহমদ দেশ ও সমাজের বিরুদ্ধে যে কাজ করেছেন, তার বিরুদ্ধে আইনজীবীরা কখনোই সোচ্চার হয়নি। এই বৈপরীত্য অনুধাবনযোগ্য নয়।
পাঁচ
জিয়াউর রহমানের মতো এরশাদও সামরিক শাসক থাকাকালীন বিভিন্ন ফরমান জারি ও সংসদে সংশোধনী পাস করান। এরশাদ অধ্যাদেশের মাধ্যমে সাংবিধানিক যেসব পরিবর্তন এনেছিলেন, তার কয়েকটি উদাহরণ :
১. ১০২ অনুচ্ছেদে রক্ষিত রিট সংক্রান্ত অধিকার বিলুপ্ত করা [২৪ মার্চ, ১৯৮২]।
২. সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিদের নিয়োগ, কোর্টের ক্ষমতা ইত্যাদি সংক্রান্ত সংশোধনী [১২ এপ্রিল ১৯৮২]। এ সংশোধনীর মাধ্যমে কামালউদ্দিন হোসেনকে অবসর গ্রহণ করিয়ে সামরিক বাহিনীর সহযোগী এ এফ এ মুনিমকে প্রধান বিচারপতি করা হয়।
৩. ‘সুপ্রিমকোর্ট ডিভিশনের স্থায়ী বেঞ্চ যে কোনো এলাকার জন্য যে কোনো স্থানে স্থাপন করা এবং উক্ত বিভাগের বিচারপতিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বদলি করার ক্ষমতা।’ ১৯৮২ সালের ৮ মে ২৪ মার্চের সামরিক আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা গ্রহণ করা হয়।
৪. জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধন।
৫. সপ্তম সংশোধনী [১০ নভেম্বর ১৯৮৬]।
৬. অষ্টম সংশোধনী [৭ জুন ১৯৮৮]।
৭. নবম সংশোধনী [১৯৮৯]।
এ পর্যায়ে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রিট দায়ের করা হয়। যে স্বাধীন আদালতের জন্য সিভিল সমাজ ও আইনবিদরা লড়াই করছিলেন, সেই আদালতের বিচারকরাই রিট খারিজ করে ঘোষণা করেন, সামরিক আইনই দেশের সর্বোচ্চ আইন। দু:খজনক হলেও সত্য যে, তারা একবারে ঘোষণা বা মন্তব্য করার এ সাহস রাখেননি যে, অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল আর জংলি আইনে পার্থক্য নেই। এভাবে সংকটপূর্ণ সময়ে প্রায় ক্ষেত্রেই বিচারকরা সিভিল সমাজের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। উল্লেখ্য, সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদও এই রায়ে স্বাক্ষর করেছিলেন।
জিয়া যেমন সংসদ তৈরি করে প্রথমেই পঞ্চম সংশোধনী পাস করিয়েছিলেন, এরশাদও সংসদ বসিয়ে সপ্তম সংশোধনী পাস করালেন। পঞ্চম সংশোধনীর বাক্যের সঙ্গে এর তেমন অমিল নেই, তাই আর তা উদ্ধৃত করলাম না। একইভাবে এই সামরিক শাসক তার নষ্টামিগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করলেন এবং আমরা তা মেনে নিলাম। এভাবে সিভিল সমাজের প্রধান উপাদানের আড়ালে সামরিক সমাজের ভিত্তিস্থাপনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রইলো।
সিভিল সমাজের বিরুদ্ধে এরশাদের প্রতিশোধমূলক সবচাইতে ক্ষতিকর সংশোধনী ছিল অষ্টম সংশোধনী। এর দু’টি দিক ছিল। একটি হলো : হাইকোর্ট বিকেন্দ্রায়নের যে প্রশাসনিক নীতি বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, ১০০ অনুচ্ছেদে ৫টি নতুন দফা সংযোজন করে তা সংবিধানের অন্তর্গত করা। অন্যদিক হলো, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে ঘোষণা করা। প্রথমটির উদ্দেশ্য ছিল সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন। ঢাকার বাইরে মানুষকে বোঝানো যে, ঢাকাতেই সবকিছু ধরে রাখার ইচ্ছে সরকারের নেই। সরকার ঢাকার বাইরে সরকারকে নিয়ে যেতে চায়। দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য ছিল, ইসলামপন্থী দলগুলোকে বোঝানো যে, সরকারি মদদ তারা সবসময় পাবে আর অজ্ঞ জনসাধারণকে বোঝানো যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে ইসলামকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমান যে কাজ শুরু করেছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল এরশাদ এই সংশোধনীর মাধমে তা সম্পন্ন করতে চাইলেন।
১৯৮৮ সালের ৯ জুন এই সংশোধনী পাস হয়। এর কয়েকটি মূল বিষয় উদ্ধৃত করছি:
“২ক। রাষ্ট্রধর্ম। -প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রের শান্তিতে পালন করা যাইবে।”
“৩০। বিদেশী খেতাব প্রভৃতি গ্রহণ নিষিদ্ধকরণ। -রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোনো নাগরিক কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নিকট হইতে কোনো খেতাব, সম্মান, পুরস্কার বা ভূষণ গ্রহণ করিবেন না।”
বাকি সংশোধনীগুলো ছিল হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কিত।
প্রাথমিক কারকদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা সংশোধনীর দ্বিতীয় দিকটি নিয়ে সোচ্চার ছিল। বুদ্ধিজীবীরা মামলা করেছিলেন, হাইকোর্টে যার কথা আগে বলেছি। মাধ্যমিক কারকরা গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন প্রথম দিকটি নিয়ে। তারাও মামলা করেন হাইকোর্টে। হরতাল পালন করা হয়। রাজপথে প্রতিবাদ হতে থাকে। শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, ‘ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা হয়েছে। আমরা যখন সুযোগ পাবো, অষ্টম সংশোধনী বাতিল করে দেবো।’ মূলত বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কমিটি ঘোষণা করে, অষ্টম সংশোধনী এরশাদের ‘গণবিরোধী কার্যক্রমের সর্বশেষ পদক্ষেপ।’
অষ্টম সংশোধনীর বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলা দায়ের করা হয়েছিল; একমাস শুনানির পর সুপ্রিমকোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রায় প্রদান করে। বিচারকগণ ‘ঢাকায় হাইকোর্টের একটি স্থায়ী বেঞ্চসহ বিভিন্ন স্থানে হাইকোর্টের ৬টি বেঞ্চ স্থাপনের বিধান সংবলিত জাতীয় সংসদে পাসকৃত অষ্টম সংশোধনী’ অবৈধ ঘোষণা করেন তবে সংশোধনীর অপর বড় অংশ ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার বিষয়টি এই আদেশের অংশ নয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকবে।’
লক্ষণীয় যে, আদালত ও আইনজীবীদের স্বার্থের সঙ্গে যা জড়িত, সেটির পক্ষে আদালত রায় দেয়। হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণে মানুষের অসুবিধা থেকে সুবিধা হতো বেশি। অন্যদিকে যে সংশোধনীটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র বদলে দিলো, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় আঘাত হানলো, সেটি সম্পর্কে আদালত নিশ্চুপ থাকলো। আরো উল্লেখ্য, একইভাবে গোলাম আযমকেও নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। গণবিরোধী রায় প্রদানের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, আদালত ঐতিহ্য তৈরি করেনি তা কি বলা যাবে?
জুলাই ১৯৮৯ সালে ভোটারবিহীন সংসদে পেশ করা হয় নবম সংশোধনী। এই সংশোধনীর মূল কথা ছিল : একাদিক্রমে কেউ দু’বারের বেশি রাষ্ট্রপতি হতে পারবে না। উপ-রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ ভোটেই নির্বাচিত হবেন। যদিও আগের তুলনায় এ সংশোধনী তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়; কিন্তু অনুমান করা হচ্ছিল- ‘বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ভিত্তিকে স্থায়ী করার জন্য এই সংশোধনীর বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। … শুধু তা-ই নয়, আপন জনগণ ও বিশ্বের চোখে দেশ শাসন করার প্রকৃত বৈধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ বর্তমান সরকার তার স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতার জন্য এই সংশোধনী পাস করিয়েছে।’
নবম সংশোধনীর বিরুদ্ধে আইনজীবীরা ছিলেন সবচাইতে সোচ্চার। এ বিল সম্পর্কে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, ‘এ বিল কেবল প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের জন্যই অবমাননাকর নয়, উপরন্তু তা জনগণ ও গণতন্ত্রের পক্ষেও অবমাননাকর।’ আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক শামসুল হক চৌধুরী বলেন, ‘এই সরকার নিজেই অবৈধ। এই সরকারের আমলে সকল সংশোধনীই অবৈধ।’
এভাবে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি জেনারেল এরশাদ সিভিল সমাজের মূল সনদ সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে সংবিধানে প্রথম পরিবর্তন আনা হয়। তারপর থেকে সংবিধানে এতো সংশোধন আনা হয়েছে যে, মূল সংবিধান এখন গবেষণার বিষয় এবং সংবিধানে জিয়া ও এরশাদ আমলে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তা গণতান্ত্রিক সমাজের পক্ষে নয়। উদাহরণস্বরূপ আবারো উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭৫ সালের ২ নং আইনের ২ ধারা বলে ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে। …’ শব্দগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে। বা সংবিধানের ৫৫/১ ধারা যেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি কর্ম পালন করবেন। এ ধারা কখনো মানা হয়নি।
এরশাদের আমলে সংবিধানে এতো সংশোধনী আনা হয়েছিল যে, সাধারণ মানুষ দূরে থাকুক, এলিটদের অনেকও এ সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এসব সংশোধন সাংবিধানিকভাবে (তার মনে হয়েছে) তার নিরঙ্কুশ শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে। অন্যদিকে সংবিধানের মূল চরিত্র যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিধৃত, তা বিনষ্ট করেছে।
ছয়
দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী করা হয় যথাক্রমে ২০ জুন ১৯৯০, ১০ অগাস্ট ১৯৯১ ও ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬। দশম সংশোধনী ছিল মহিলা আসন সংরক্ষণ সংক্রান্ত। একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত। একাদশ সংশোধনীর প্রস্তাবনাটি গুরুত্বপূর্ণ :
‘যেহেতু অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক সরকার অপসারণ করিয়া একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার লক্ষ্যে দেশব্যাপী দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে বাধ্য হন এবং যেহেতু দল মত নির্বিশেষে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-কর্মচারী, পেশাজীবী সংগঠন, প্রধান রাজনৈতিক জোট ও দল প্রধান বিচারপতি জনাব সাহাবুদ্দীন আহমদকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান;…’
সুতরাং বেগম জিয়া যে বলেছেন, একাদশ সংশোধনী বিএনপির করা, যা তার একক কৃতিত্ব নয়। দেশের রাজনৈতিক জোট বা মানুষরা একত্রিত হয়ে এই সংশোধনীর প্রস্তাব করেছিল, যা পাস না করার ক্ষমতা বিএনপির ছিল না।
একই কথা প্রযোজ্য দ্বাদশ সংশোধনী সম্পর্কে। বিএনপি এই সংশোধনীতে রাজি ছিল না। আওয়ামী লীগই এই দাবিতেও সোচ্চার ছিল। বরং এভাবে বলা যায়, ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি শাসন প্রবর্তন করেছিল; আবার আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলের উদ্যোগেই সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে। সুতরাং এই কৃতিত্বও এককভাবে বিএনপির নয়।
ত্রয়োদশ সংশোধনীও পাস হয়েছে শেখ হাসিনার সময়ে। জেনারেল জিয়ার কুখ্যাত পঞ্চম সংশোধনীর সবচাইতে কুখ্যাত অংশটি বাতিল করা হয় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে। খালেদা জিয়ার কিছু করার ছিল না। তার মনে কী ছিল তখন, সেটা বোঝা গেল ২০০১-এর পর। এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যামামলা বন্ধ হয়ে যায়। আবার ইনডেমনিটি চালু করা হয়।
বেগম জিয়া মওদুদ আহমেদ তথা জামায়াত-বিএনপিরা সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন চতুর্দশ সংশোধনীর জন্য। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সংশোধনীর কি অতীব জরুরি ছিল? এটার মধ্যে কি জনকল্যাণ নিহিত? কেন করতে হলো এখন। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থ এবং মতলববাজি ছাড়া আর কিছু নেই। আর একথাও মনে রাখা দরকার, জামায়াত বিএনপি ও মওদুদ-নিজামী কোনো দুরভিসন্ধি ছাড়া কোনো কিছু করেন নি।
সেই যে গাঁটবন্ধন করে গিয়েছিলেন জিয়া, তারই ধারাবাহিকতায় জামায়াত ও বিএনপিরা একযোগে আবার নষ্টামির এই সংশোধনীটি করেছে। সেজন্য বলছিলাম, পঞ্চম সংশোধনীর ধারাবাহিকতায় এটি করা হয়েছে। আর এরশাদ-জিয়াতে চেহারায় ছাড়া পার্থক্য কি আছে? হ্যাঁ, একটি আছে। এরশাদের পত্নী-প্রেম ক্ষণে ক্ষণে প্রবল। তার আমলে রওশন এরশাদকে ফাস্টলেডি বলা হতো। জিয়া তার সময় বেগম জিয়াকে সর্বসমক্ষে আসতে দেননি। সে থেকেই বেগম জিয়ার মধ্যে হয়তো প্রদর্শনমূলক ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়, যার ফলে চতুর্দশ সংশোধনী। এই সংশোধনীর মূল বিষয় কী? প্রথমেই দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি টাঙানো। দু’জনের কেন? একজনের হলে তো আপাতত বেগম জিয়ার ছবি টাঙানো যাচ্ছে না। তাই জোর-জবরদস্তি সবখানে তার ছবি টাঙাতে চান। তবে এটিই মূল উদ্দেশ্য নয়। মানুষের যে কতরকম সাধ থাকে! সাদ্দাদও তার বেহেশত নিয়ে খোয়াব দেখেছিল, কিন্তু তা গিয়েছিল হাওয়া হয়ে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিচার ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যদের চাকরির বয়স বাড়ানো। এতে সবচাইতে অবিচার করা হয়েছিল সাবেক প্রধান বিচারক এম এ হাসানের প্রতি। তিনিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতেন এবং তাকে চিহ্নিত করা হলো জামায়াত-বিএনপির চিহ্নিত প্রধান হিসেবে। নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপি ‘জয়ী’ হলে এর দায় বহন করতে হতে জনাব হাসানকে। শুধু তা-ই নয়, মওদুদ বলছিলেন, বর্তমানে সিনিয়র বিচারকরা অবসর নিয়ে ‘যোগ্য, প্রাজ্ঞ ও দক্ষ বিচারক সংকটে পড়বে।’ এ মন্তব্য করে তিনি অন্যান্য বিচারক ও আইনজীবীকে নিয়ে প্রশ্ন তুললেন যা তুলেছেন বিএনপি-জামায়াত নেতা খোন্দকার মাহবুবুউদ্দিন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চিহ্নিত দলীয় কিছু লোক বসানো হয়েছে, যাতে দলীয় ক্যাডারদের সরকারি নিয়োগ অব্যাহত থাকে। বিএনপি যদি কোনো কারণে ক্ষমতায় না থাকে, তাহলে জামায়াত-বিএনপিরা যেন চাকরি পায় সেটি অব্যাহত রাখতেই এ প্রচেষ্টা। আর সংরক্ষিত নারী আসনের উদ্দেশ্য পুরো সংসদটাই যেন নিজের হয়। সেনাবাহিনীর জোরে দুই-তৃতীয়াংশ পাওয়া বিএনপি তখন সন্তুষ্ট হয় নি। তা হলে বর্জ্য হিসেবে গামছা গলায় দেয়া বা সাফারি পরা জেনারেলদেরও ছুড়ে ফেলে দেয়া যাবে। আমরা আর কী বলবো, এখন বার সমিতিতে পরাজিত জামায়াত-বিএনপি প্রার্থী ব্যারিস্টার জহির পর্যন্ত দু:খ করে বলেছিলেন, এসব সংশোধনীর কী দরকার, তা তার মাথায় আসছে না। আর মুসলমানদের দেশে ছবি টাঙানো বাধ্যতামূলক করাটাও কি উচিত ছিল? এ প্রশ্নটি নালায়েক জামায়াতিদের করা দরকার।
বেগম জিয়া যে বলেছেন তখন, নারীদের সঙ্গে আলোচনা করে নারী আসন বিষয়ে সংশোধন করেছেন, এটা কি সত্যি? তার বাসার নারীদের নিয়ে কী আলোচনা করলেন, তা অবশ্য আমাদের জানার কথা নয়; কিন্তু আমরা পত্রপত্রিকায় তখন দেখেছি, বাংলাদেশের প্রতিটি নারী সংগঠন এর বিরোধিতা করেছে, এমনকি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার পত্নী অ্যাডভোকেট সিগমা হুদাও ম্রিয়মাণ কণ্ঠে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নারীরা চেয়েছিলেন প্রত্যক্ষ নির্বাচন ফলে দেখা যায়, এই সংশোধনী পুরোটা মতলববাজিতে ভরা। ব্যক্তি ও দলের মুখ চেয়ে করা। এতে দেশবাসীর কল্যাণ খুঁজে পাওয়া গেল না। প্রধানমন্ত্রীর ছবি টাঙানোতে দেশবাসীর কী লাভ? ওই ছবি দেখে কি তার খিদে মিটবে? না, বাজারের দাম কমানোটা প্রয়োজন ছিল? নারী আসন বাড়িয়েও তাতে বিএনপি অনুরাগী মহিলারা গেলে সাধারণ মানুষ বা মহিলাদের কী লাভ? সেই সময় মৌলবাদের উত্থান, প্রতিনিয়ত মানুষ খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে বাংলাদেশ সরকার বা জামায়াত-বিএনপির কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেগম জিয়ার ছবি টাঙানো।
আরেকটি বিষয় যা সবার চোখ এড়িয়ে গেছে, তাহলো- এ সংশোধনীতে বাংলাভাষার গুরুত্বকে হ্রাস করে ইংরেজিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটি বাঙালির মূল চেতনার বিরোধী। তাছাড়া বিচারকদের অবসরের সীমা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ, যাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হয়।
সেই সংসদে গৃহপালিত দুই নম্বর বিরোধী দল এরশাদের জাপা এই সংশোধনী সমর্থন করেছে। খুবই স্বাভাবিক। এরশাদ নিজেও এসব খারাপ কাজ করেছেন। আর একজন জেনারেল হিসেবে একজন জেনারেল-পত্নীকে সম্মান করা কর্তব্য। কারণ পত্নীও ছিলেন ক্যান্টনমেন্টবাসী। লক্ষণীয়, সামরিক শাসক ও তাদের অনুরাগীরাই এ পর্যন্ত বাংলাদেশ চেতনাবিরোধী, বাঙালি সমাজবিরোধী সংশোধনীগুলো এনেছে। নষ্টামিতে তাদের সত্যিই জুড়ি মেলা ভার।
ঐক্যফ্রন্ট যে আবার সংবিধানে সংশোধনী আনতে বলছে তা কি জনস্বার্থে? দেশে কি এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে তাদের সংশোধনী আনতে হবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি আগে গ্রহণ করা হতো যদি দেশের মানুষ তা না চাইত? এখন ঐক্যফ্রন্ট ছাড়া কি এ দাবি আর কেউ করছে?
সাত
ড. কামাল হোসেনের প্রসঙ্গ এখানে বারবার এসেছে। একথা অস্বীকার করা ঠিক হবে না যে, ১৯৭২ সালের সংবিধান রক্ষায় তিনি আন্দোলন করেন নি। অষ্টম সংশোধনীর বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সেচ্চার। বিএনপির সংশোধনগুলির বিরুদ্ধেও তিনি বলেছেন। আবার এখন ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে’ বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করছেন। আসলেই এটি সব সম্ভবের দেশ।
আজ ড. কামাল দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত। যারা দলে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা নেই তিনি ‘গণতন্ত্রের’ স্বার্থে এগিয়ে এসেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার যারা সমর্থন করেন না, তাদের স্বার্থে তিনি এগিয়ে এসেছেন। এ প্রশ্ন কেউ তোলেনি, এমনটা আওয়ামী পস্থিরাও যে, পৃথিবীতে কোন দেশে কেউ মানবতা বিরোধী অপরাধ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি এবং বিচার সমর্থন করেছেন। সেটিই সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ খুনিদের কোনও স্থান নেই গণতন্ত্রে, সমাজে, রাষ্ট্রে, খুনীদের যারা সমর্থন করে তারাই খুনের সহযোগী। ১৯৭২ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ আইনের যে সুরক্ষায় কামাল হোসেন সমর্থন করেছেন, সেই তিনিই এখন সেই সাংবিধানিক আইনে বিচার করা খুনি ও তার সহযোগীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। কী বলবেন আপনারা?
আরো আছে, ঐক্যফ্রন্টের এখন তিনি স্বীকৃত নেতা। কিন্তু, সবাই মনে করেছিল, তিনি সুতা পরিমাণ হলেও বিএনপি থেকে দূরে থাকবেন। বলেছিলেন, ঐক্যফ্রন্ট হলো বটে, কিন্তু যে যার প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। এখন ঘোষণা করা হলো ড. কামাল হোসেনের দলও ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করবে। কামাল হোসেনের ব্যাপারে সন্দেহবাদীরা অনেক কথা বলতেন। আমরা বিশ্বাস করিনি, ভেবেছি ব্যক্তিগত কারণে তিনি শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেনি। আমাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি সজ্জনের মতো আচরণ করেছেন। কিন্তু এখন তার ‘ইনটেগ্রিটি’ বা সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যিনি প্রগতির ধারক বলে সুশীলদের ধারণা তিনি জামায়াত-কে সমর্থন করেন কী ভাবে? জামায়াতও ধানের শিষ নিয়ে নির্বাচন করবে। আমি গত পাঁচ বছর ধরে লিখেছি বলেছি যে, বিএনপি-জামায়াত দলের এপিঠ-ওপিঠ। অনেকে তাতে ক্ষুদ্ধ হয়েছেন বিশেষ করে যারা মৃদু বিএনপি। তারেক জিয়া ঘোষণা করেছিলেন- ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির একই মায়ের সন্তান। পিতার কথা বলেন নি। তবে, অনেকের অনুমান পিতা আইএসআই ছাড়া আর কী হতে পারে। এই গতকাল বিএনপির এক নেত্রী লন্ডনে ঘোষণা করেছেন, বিএনপি-জামায়াত একই মায়ের সন্তান। পিতা কে? নিশ্চয় পাকিস্তান।
ড. কামাল হোসেন সংকটে সব সময় বিদেশে থেকেছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে গেছেন, অন্তত পাকিস্তানি জেনারেলরা তাই বলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় বিদেশ ছিলেন। সামরিক শাসনের সময় প্রায় বিদেশ থেকেছেন। মাঝে মাঝে এসে গণতন্ত্র ও সংবিধানের কথা বলেন। বাস্তবে, খুনিদের পক্ষে থাকেন।
কাকে বিশ্বাস করবেন? ভোটের আগে আওয়ামী লীগ হেফাজতিদের তোয়াজ করেছিল। এখন হেফাজতিরা শেখ হাসিনাকে বলেন, কওমি জননী। আওয়ামী লীগ নেতা, নিজ এলাকার সাংসদকে হারানোর জন্য বিএনপি নেতার সঙ্গে কথা বলেন- কাগজে এ খবর এসেছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা যখন জামায়াতীদের দলে আনার পাঁয়তারা করছিল তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমার এখন অভাব পড়েনি যে জামায়াতকে আনতে হবে। যাক, সব দলের রাজনীতিতেই বিভ্রান্তি আছে, মানুষজন একারণে খানিকটা হলেও বিভ্রান্ত ও রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ। কিন্তু আমাদের সারা জীবনটাই কেটেছে রাজনীতির ভেতর এবং এটিও বিবেচ্য যে, তরুণরাই বাংলাদেশকে জিঁইয়ে রেখেছে। ১৯৫২ সালে তরুণরা ভাষা আন্দোলন করেছে। ১৯৫৪ সালে তরুণরাই গণ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ১৯৭১ সালে তরুণরাই এগিয়ে এসেছেন। যে কারণে শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছেন।
এখনও তরুণরাই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে। এখন প্রতিক্রিয়ার পক্ষে, খুনিদের পক্ষে, জোরালো দুর্নীতি ও ফেরেববাজদের পক্ষে, জঙ্গি মৌলবাদের পক্ষে আছেন ড. কামাল হোসেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের স্পিরিটের পক্ষে, খুনিদের বিপক্ষে, মৌল জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীর বিপক্ষে, উন্নয়নের পক্ষে আছেন ১৪ দল যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা প্রযুক্তি ও উন্নয়নের মেল-বন্ধন ঘটিয়েছেন যার বেনেফিশিয়ারি হবে আজকের প্রজন্ম। এর ওপর ভিত্তি করেই তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে যাবে।
সে জন্য বলছি, রাজনীতির বাইরে আমরা কেউ নই। হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না। পাকিস্তান আমলেও তো রাজনীতি এমনই ছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মানুষকে হাল ছাড়তে দেয়নি।
বাংলাদেশ হয়েছে। বাংলাদেশে রাজনীতি যেন খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া বা ড. কামাল হোসেনদের হাত থেকে রেহাই পায়। ড. কামাল হোসেনের এতো সমালোচনা সত্ত্বেও বলব, ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে থেকে তিনি ঐক্যফ্রন্ট্রের দুবৃত্তদের উগ্রতা হ্রাস করতে পারছেন । ইতিবাচক কথা বলছেন। কতদিন পারবেন অবশ্য প্রশ্ন সাপেক্ষ।
শেখ হাসিনা তার প্রজ্ঞা দিয়ে সুযোগসন্ধানীদের জন্য রাজনীতি যথেষ্ঠ কঠিন করে তুলেছেন। একবার ভাবুন- ড. কামাল, কাদের সিদ্দিকী বলছেন, শহীদ জিয়া অমর হোক, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ডা. বি চৌধুরী, যিনি চরম সাম্প্রদায়িক, তিনি বলছেন, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। মান্না আত্মত্যাগ করেছেন মা খালেদার জন্য। নির্বাচন এখন হচ্ছে, যেভাবেই হোক ক্ষমতায় যাওয়া এবং লুট করা। সংবিধান, রাষ্ট্র, সমাজ কিছু নয়। আদর্শ দুরস্ত। এ অবস্থায় সংবিধান রক্ষার্থে রাজনীতি রক্ষার্থে তরুণদের কাজ হবে, এসব ভণ্ড যে মার্কা নিয়েই দাঁড়াবে তাদের ভোট না দেয়া যাতে রাজনীতি থেকে তারা চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
এ কারণে, হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না, বিভ্রান্তও হওয়া যাবে না। নতুন প্রজন্মকে এ রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ফেরত আসে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে আর ফেরা যাবে না কিন্তু ওই সংবিধান মানুষের অধিকার ও সম্মান যেভাবে রাখা হয়েছিল, যে প্রগতির বাংলাদেশের রূপরেখা ছিল, সে বাংলাদেশ যেন ফিরে পাওয়া যায় বা সৃষ্টি করা যায়।
Add Comment