মুনতাসীর মামুন

মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন, ওরফে মুনতাসীর মামুনের জন্ম ঢাকার ইসলামপুরের আশেক লেনে, নানার বাড়িতে, ২৪ মে ১৯৫১ সালে। পিতা মিসবাউদ্দিন খান, মা জাহানারা খান। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে। পিতা-মাতার তিন পুত্রের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ।

পিতার কর্মসূত্রে মুনতাসীর মামুনের শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামে। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানেই। চট্টগ্রাম পোর্ট  ট্রাস্ট প্রাইমারি ও হাই স্কুল এবং চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা শেষে ১৯৬৮ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। এ বিভাগ থেকে ১৯৭২ সালে লাভ করেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। একই বিভাগ থেকে ঐতিহাসিক সালাহউদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধানে ১৯৮৩ সালে লাভ করেন পিএইচডি ডিগ্রি। মুক্তিযুদ্ধের পর ইতিহাস বিভাগ থেকে তিনিই প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তৎকালীন দৈনিক বাংলা ও বিচিত্রায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন প্রভাষক হিসেবে। বর্তমানে একই বিভাগের অধ্যাপক ও প্রাক্তন সভাপতি।

ছাত্রজীবন থেকেই মুনতাসীর মামুন বাংলাদেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের তিনি ছিলেন সাহিত্য সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনায় ডাকসুর মুখপত্র হিসেবে নিয়মিত বের হয়েছে পাক্ষিক ছাত্রবার্তা। একই সময় ছিলেন সংস্কৃতি সভাপতি। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন গড়ে তোলার কাজে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ লেখক শিবির ও বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক এবং যুগ্ম সম্পাদক।

বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে তিনি নানা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর সাম্মানিক প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (১৯৯৯-২০০২)। কয়েকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল ও সিনেটের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটেরও সদস্য। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) গভর্নিং বডির সদস্য। তিনি ছিলেন জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ড ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এবং জাতীয় আর্কাইভসের পরিচলনা পর্যদের সদস্য। ঢাকা নগর জাদুঘরের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকার ইতিহাসচর্চার জন্য এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ঢাকা চর্চা কেন্দ্র’ (সেন্টার ফর ঢাকা স্টাডিজ)। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজের (আইসিবিএস) তিনি প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো। খুলনায় গড়ে ওঠা ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন ও আর্কাইভ জাদুঘর’-এর তিনি সভাপতি।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বর্তমান সহ-সভাপতি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ ও সরাদেশে বধ্যভূমির নির্মিতব্য স্মৃতিস্তম্ভ কমিটির তিনি অন্যতম সদস্য। ১৯৯৬ সালে পাঠ্যবই সংস্কারের জন্য যে কমিটি হয়েছিল তিনি তার সদস্য। ১৯৯৮ সালে গ্রন্থগার ও গ্রন্থনীতি সংস্কার কমিটির তিনি ছিলেন সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্র ও আর্কাইভসের তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা এবং পরিচালক হিসেবে সংস্থার কার্যক্রম শুরু করেন।

তিনি ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা মামুন প্রতিষ্ঠা করেন মুনতাসীর মামুন-ফাতেমা ট্রাস্ট। এই ট্রাস্ট দরিদ্র ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে নিয়মিত সাহায্য করছে।

গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক হিসেবে তিনি বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা সংস্থার ফেলো ও বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করেছেন। যেমন-জাপানের কিতাকিস্যু ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ফরেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টোরিকাল রির্সাচ, নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট অব সোসাল সায়েন্স প্রভৃতি। শেষোক্ত পরিষদের ‘নির্মল কুমার বসু স্মারক বক্তৃতা’, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘দীনেশচন্দ্র সেন স্মারক বক্তৃতা’ এবং রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিপ্লবী গণেশ ঘোষ স্মারক বক্তৃতা’ প্রদান করেন।

বিভিন্ন উপলক্ষে ভ্রমণ করেছেন ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মিসর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোকিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়া, ইতালি, স্পেন, সাইপ্রাস, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া।

মুনতাসীর মামুন ইতিহাসচর্চা ও সৃজনশীল সাহিত্যের জন্য অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পুরস্কার, ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার, সিটি-আনন্দ আলো পুরস্কার, নূরুল কাদের ফাউন্ডেশন পুরস্কার, হাকিম হাবিবুর রহমান ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক, লেখক শিবির পরস্কার, ড. হিলালী স্বর্ণপদক প্রভৃতি।

মুনতাসীর মামুন ১৯৭৫ সালে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা মামুন ছিলেন ব্যাংকার, বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। তাঁদের তিন সন্তান মিসবাহউদ্দিন মুনতাসীর, নাবীল মুনতাসীর এবং রয়া মুনতাসীর।