তখন ছিলাম কোথায়? : আজ থেকে এক দশক আগেও বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে বেরুতে সংকোচ হতো। আরো আগের তো কথাই নেই। অথচ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন অধিকাংশ দেশে যেতে বাঙালির ভিসা লাগত না। বাঙালি তখন বীরের জাতি হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৫ সালের পর থেকে দৃশ্যপট বদলে গেল। কারণ, বাংলাদেশ তখন পরিচিত হয়ে উঠল হন্তারক দেশ হিসেবে। তারপর দুই জেনারেলের মিলিটারি শাসন। বাংলাদেশ পরিচিত হয়ে উঠলো ডিকটেটরের দেশ হিসেবে। এরপর খালেদা-নিজামীর জঙ্গি মৌলবাদী শাসন। বাঙালি পরিচিত হয়ে উঠল জঙ্গি মৌলবাদী কোথাও বা মধ্যপন্থি ইসলামি দেশ হিসেবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সেক্যুলার দেশ হিসেবে। অথচ তিনযুগে বিভিন্নভাবে তার পরিচয় বদলেছে। সবাই এ দেশটিকে তখন ব্যর্থ হন্তারক একনায়কী জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করেছে। সুতরাং সবুজ পাসপোর্ট দেখলেই ইমিগ্রেশন কর্তাদের ভ্রু কুঁচকে যেত।
এই রাষ্ট্রের গায়ে আরেকটি তকমা ছিল। কিসিঞ্জার বলে গিয়েছিলেন। তলাবিহীন ঝুড়ি অর্থাৎ ভিক্ষুক রাষ্ট্র। সুতরাং বিদেশের দরজায় যাওয়ার উদ্দেশ্য ঐ রাষ্ট্রের উন্নয়নে সহায়তা নয় বরং ভিক্ষা করা। আমার মনে আছে বছর ২৫ আগে যখন জাপান যাই, তাদেরই আমন্ত্রণে, তখন আমার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করা হয়েছিল। ইমিগ্রেশনের লাইনে ছিলাম। আমার পাসপোর্ট দেখে আমাকে আলাদা করা হলো। সবাই বিদেয় হলে তারপর ১৫/২০ মিনিট পরীক্ষা করার পর আমার পাসপোর্টে সিল পড়ল। এর কারণ তখন বিভিন্ন রাষ্ট্রে বাঙালিরা যাচ্ছে ভাগ্য ফেরাবার আশায়। তারা এটি পছন্দ করছে না। কিন্তু, মজার ব্যাপার হচ্ছে, চীন কোরিয়া থেকে তখন আরো বেশি মানুষ যাচ্ছিল জাপান, এমনকী ইরান বা পাকিস্তান থেকেও, কিন্তু জাপানিরা তাদের সঙ্গে খুব একটা খারাপ ব্যবহার করত না, চীন বা কোরিয়ানদের সঙ্গে তো নয়ই। কারণ, আকারে, ক্ষমতায় সেগুলো ছিল শক্তিশালী। বাংলাদেশ তখন শুধু গোলমেলে রাষ্ট্রই নয়, দুস্থ রাষ্ট্রই বটে। ক্ষমতাবানদের কেউ সহজে ঘাটাতে চায় না।
এ থেকে আমাদের জেনারেশন একটি শিক্ষা নিয়েছিলাম। যে লক্ষ্য সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তা পূরণ হয়নি। এর জন্য ১৯৭২-৭৫ অবস্থা পটভূমি হিসেবে বিচার করলেও মূল দায় ১৯৭৫-এর পর জেনারেল জিয়ার কাঁধে। প্রথমে সংবিধান সংশোধন ও রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন যা তিনি করতে পারেন না কিন্তু বুকের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে কাজটি তিনি করেছেন। আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার করা যাবে না বলে ইনডেমনেটি আইন পাশ করেছেন। যা তিনি পারেন না। জামায়াতে ইসলাম ও অন্যান্য নিষিদ্ধ দলকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন যা বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ করেছিলেন। এই প্রথম বিশ্বে বিশ্বাসঘাতক ও খুনীদের ডেকে এনে রাষ্ট্র সমাজে পূনর্বাসন করা হয়েছিল। আরো প্রচুর অপকর্ম করেছেন। আজ এটি স্পষ্ট যে, মুক্তিযুদ্ধে তিনি গিয়েছিলেন বাধ্য হয়ে, আসলে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন পাকিস্তানবাদে। বাঙালির আত্মপরিচয় বদলে বাংলাদেশি করার মাধ্যমে তিনি এই বার্তা দিয়েছিলেন যে ১৯৭১ সাল একটি ব্যত্যয়, বাংলাদেশের মূল ধারা ১৯৪৭। লে.জে. জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের যত ক্ষতি করেছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কেউ তা করেননি।
লে. জে. হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়াও একই ধারা অনুসরণ করেছিলেন। ফলে গত তিন দশকে যে সব শিশুরা সাবালক হয়েছে তারা বেড়ে উঠেছে ভায়োলেন্স, জঙ্গি মৌলবাদ, দায়হীন সংস্কৃতির মধ্যে। এ কারণে, আজ মানবতাবিরোধী অপরাধী ও তাদের দলের সমর্থক বেড়েছে, মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এমন কী বঙ্গবন্ধুকে ‘পাক বন্ধু’ বলতেও কেউ কেউ দ্বিধা করছে না। যে ব্যক্তি একথাটি উচ্চারণ করছেন সে ব্যক্তিকে জামায়াত-বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদে দেখতে চায়। জাতির জনক যদি ‘পাক বন্ধু’ হন তা’হলে ইয়াহিয়া খানকে তারা জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এ রকম বিকৃতমনা ভয়ঙ্কর লোকসব যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় যায় তাহলে বাংলাদেশ ও নতুন প্রজন্মের অবস্থা কী হবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। তারা সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে দেশের বাইরে পা রাখতে পারবেন না।
১৯৪৭ সালের পর থেকে যদি বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনা করি তা’হলে দেখব সেক্যুলার, জাতীয়তাবাদী, গণতন্ত্রীমনা দল বা দলগুলি যদি একত্রিত হয়ে অপশক্তিকে প্রতিরোধ করে এবং ক্ষমতায় যায় তখন দেশে শান্তি ও স্থায়িত্ব ফিরে আসে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় এবং সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। কয়েকটি উদাহরণ দিই।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছিল একেবারে বিধ্বস্ত। বঙ্গবন্ধুর পুরো সময়টাই কেটেছে যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশে ন্যূনতম অবকাঠামো গড়ে তোলা ও সাধারণ মানুষের খাদ্যের বন্দোবস্ত করার যেটি অন্তিমে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে সম্ভব হয় নি। কিন্তু, মূল বিষয় হলো সংবিধান থেকে শুরু করে বাজেট সবকিছু নিবেদিত ছিল সাধারণ মানুষের জন্য। এমনকি বিশ্বব্যাংকের ডিকটাট মানতেও রাজি ছিল না বাংলাদেশ। শেখ মুজিব বলেছিলেন, “ফান্ডামেনটালী আমরা একটা শোষণহীন সমাজ গড়তে চাই। আমরা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি করতে চাই।” দেশের পরিস্থিতি ১৯৭২ সালে কী দাঁড়িয়েছিল তার দু’একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ১৯৭১ সালে চাল ছিল প্রতি মণ ৩৪.৩৬, ১৯৭২ সালে ৯৩.৭৫, চিনি প্রতি সের ২.২৭, ১৯৭২ সালে ৯ টাকা। সরষের তেল ৫.২৭ প্রতি সের, ১৯৭২ সালে ৯৩.৭৫ এ অবস্থায় দেশের ভার গ্রহণ করেও তিনি চেষ্টা করেছিলেন শান্তি, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারণে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হলেও ১৯৭৫-এর দিকে শৃঙ্খলা ফিরে আসছিল। শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ কর্মসূচি গ্রহণ করার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতার লক্ষণ ফুটে ওঠে। চালের দাম ৮ টাকা থেকে সাড়ে ৫ টাকায়, আলু ২.৭৫ থেকে ১.৫০ পয়সায় নেমে আসে। ঢাকা শহরে মধ্যবিত্তের ব্যয় সূচক ৪৫৮.৫ (জানুয়ারি) থেকে ৪১৬.৯ (এপ্রিলে) এবং খাদ্যমূল্য সূচক একই সময়ে ৪৫৯.০ থেকে ৪৪৬.৩ হ্রাস পায়। আগস্ট মাসে অবস্থার আরো উন্নতি হয় ভালো আবহাওয়া ও ভালো ফসল হওয়ার কারণে। দ্রব্যমূল্য নামতে থাকে। ১লা সেপ্টেম্বর থেকে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা শুরু হওয়ার কথা কিন্তু তার আগেই ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিব।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা সংহত করার জন্য যখন দল গঠন করেন তখন তাঁর সমর্থকদের প্রচুর অবৈধ অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা দেন। বলা হয়ে থাকে, তাঁর আমলে দুর্নীতি যে পর্যায়ে পৌছেছিল তার আগে এ ভূখণ্ডে তা দেখা যায়নি। বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, ব্যবসার নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলি জিয়া সমর্থকদের ঋণ দিতে থাকে। তারা তা গ্রহণ করে আর ফেরত দেয়নি [অধিকাংশ]। এভাবে বাংলাদেশে ‘ঋণ খেলাপী’ নামে শক্তিশালী একটি চক্রের সৃষ্টি হয়। বিএনপির রাজনৈতিক কর্মীরা ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করে। সেনাবাহিনীতে বিনা কারণে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। ১৯৮১ সালে সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে জমা হয়েছিল ৫০০ কোটি কালো টাকা। কারণ ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ও ঔপনিবেশিক মতাদর্শ অক্ষুণ্ণ রেখে যারা ক্ষমতার আসেন তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় নিজের ঘনিষ্ঠ চক্র বা সমর্থকদের সন্তুষ্ট রাখা, সাধারণ মানুষকে নয়। সাধারণ মানুষের অবস্থা তখন কী দাঁড়ায় তারও দু’একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ সালে যেখানে চাল প্রতি মণ ছিল ৬০ টাকা, ডাল ৩.৫০ প্রতি সের, ডিমের হালি ১.২৫, তরিতরকারি প্রতি সের গড়ে ২.১৭ টাকা। ১৯৭৮ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১০০ টাকা, ৯ টাকা, ৪ টাকা ও ৪.০৬ পয়সা। আরো কিছু সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব দেয়া যায়- ১৯৬৯-৭০ এর তুলনায় ১৯৭৮-৭৯ সালে চালের ব্যবহার মাথা পিছু হ্রাস পায় ১৬২ কিলোগ্রাম থেকে ১৪০ কিলোগ্রাম। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে ভূমিহীনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫১ শতাংশে। ১৯৬৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৯ শতাংশ। জিয়ার কৃষিমন্ত্রী পর্যন্ত জানান, ‘ভূমিহীন ও ভাগচাষীরা প্রকৃতপক্ষে সকল প্রকার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। জমির মালিকদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক দাস প্রভু ও ক্রীতদাসের মতোই।’
১৯৭৯ সালে, জিয়া যখন ক্ষমতার শীর্ষে তখন বাংলাদেশে ‘কর্মদক্ষ জনসমষ্টির এক-তৃতীয়াংশ ছিল কর্মহীন।” গ্রামের মানুষ ১৯৭৫-৭৬ সালে গ্রহণ করতেন ৮০৭ গ্রাম খাদ্যদ্রব্য। ১৯৮১-৮২ তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৭৪৬ গ্রামে। ১৯৭৫-৭৬ সালে গড় পড়তা ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ ছিল ২০৯৪ এ, ১৯৮১-৮২ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১৯৪৩-এ যা নিম্নতমের চেয়ে ১৫ ভাগ কম। ১৯৮১-৮২ সালে তিন চতুর্থাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগেছেন। ১৯৭৭-৭৯ সালে উচ্চ শিক্ষার্থী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা হ্রাস পায় ২১ শতাংশ। এ ধরনের ইতিহাসের ধারায় যারা ক্ষমতায় আসেন তারা কীভাবে মানুষজনের সঙ্গে প্রতারণা করেন তা বোঝা যাবে একটি উদাহরণ দিলে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে জিয়া প্রতিশ্রুতি প্রকল্পসমূহের মূল্যায়নের জন্য একটি বৈঠক ডাকা হয় তাতে দেখা যায়, ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সড়ক ও জনপথ বিভাগে যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয় তা যদি অব্যাহত থাকে তা হলে প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুত প্রজেক্ট বাস্তবায়নে ৬২ বছর সময় লাগবে।’
এমনকি ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান পর্যন্ত এক বক্তৃতায় বলেন যে, উন্নয়নের জন্য সংরক্ষিত মোট সম্পদের চল্লিশ ভাগ বিনষ্ট হচ্ছে দুর্নীতির এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য। অর্থনীতিবিদদের এক সম্মেলনে তিনি একথা স্বীকার করেছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বোধহয় ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এর পরিচালক আবদুল মোমেন লিখেছিলেন-
“Corruption has been converted from a crime to a habit and the acknowledgment of this fact has led to a faster growth of corruption in the country. Following it has appeared political corruption which has taken upon itself the protection of other crimes.”
আগেই উল্লেখ করেছি জেনারেল এরশাদ, জিয়ার পথই অনুসরণ করেছিলেন। তাঁর আমলের বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্রের ও নিজের এবং তল্পীবাহকদের সম্পদের মধ্যে পার্থক্য না করা। এরশাদ আমলে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে তার পরিবার ও নতুন সমর্থকগণ। তাঁর সময়ে “উন্নয়ন বাজেটের মধ্যেও মূল আঘাত গিয়ে পড়েছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো সামাজিক অবকাঠামো খাতের ওপর।” সাধারণ মানুষ এমন নিঃস্ব অবস্থায় পৌছে যে গণঅভ্যুত্থানে অবশেষে এরশাদ বিদায় হন।
এখানে তাঁর আমলের কয়েকটি সংখ্যাতত্ত্ব তুলে ধরেছি উদাহরণ হিসেবে। এক হিসেবে জানা যায় মাত্র ২৫টি প্রকল্পে লোপাট হয়েছিল ১৩,৪৮৫ কোটি টাকা, লক্ষ্যণীয় যে এ সমস্ত প্রকল্পগুলি ঘুরে ফিরে স্বল্প কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই লাভ করেছিল। এদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট, তাঁর স্ত্রী, নিকট আত্মীয়স্বজন, মন্ত্রীবর্গ, আমলাবৃন্দ। অর্থাৎ সরকারি যে কোনো প্রকল্প কেউ পেলে তাকে দশ ভাগ কমিশন দিতে হতো। এ পরিসংখ্যানে জানা যায়- “১৯৮৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত শিল্পঋণ সংস্থার মেয়াদোত্তীর্ণ অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭শ’ কোটি টাকা। ঐ টাকা আটকে ছিল ৩৮২টি প্রকল্পে। আর সেই ৩৮২টির মধ্যে মাত্র ২২টি প্রকল্পেই ছিল প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। যার অর্থ হচ্ছে ২২ জন ব্যক্তি বা গ্রুপ শিল্পঋণের প্রায় অর্ধাংশ আত্মসাৎ করে বসে আছে।… ১৯৮৪ সালের জুনের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ছিল ১শ’ ৭০ কোটি টাকা, যা ৫ বছর পর ৭শ’ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ এই ৫ বছরে যে সকল ব্যক্তি ঋণের সুযোগ গ্রহণ করেছেন তাদের বড় অংশই সুস্পষ্টভাবে জনগণের সম্পদকে কুক্ষিগত করেছে।”
অনার্জিত অর্থে ধনীগোষ্ঠীর সদস্যের সংখ্যা কিভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল তা বোঝা যাবে ১৯৯০ সালের মাশির হোসেনের রিপোর্টে। এই রিপোর্টের উপাত্তই স্পষ্ট করে দেয় বাংলাদেশের অর্থনীতি কিভাবে পণবন্দী হয়ে গিয়েছিল স্বৈরাচারী শাসকের হাতে। তাই দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও রিপোর্টের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছিল-
“৮৯ সালের জুন মাসের হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকে ৮৬৯টি কোটি টাকার একাউন্ট রয়েছে। আর এতে জমা আছে ২,৩৮৭ কোটি টাকা। দেড় বছর আগে অর্থাৎ ’৮৮ সালের ডিসেম্বরে একই ব্যাংকে কোটি টাকার একাউন্টের সংখ্যা ছিল ৬৮৯টি। জমা ছিল ১৬৮৯ কোটি টাকা। একাউন্টের সংখ্যা দেড় বছরে বেড়েছে ১৮২টি। জুন ’৮৯-এ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে জমা টাকার পরিমাণ ছিল ১৮,০৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি খাতে জমা হচ্ছে মাত্র ৪,২৬৭ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতে জমা ছিল ১৩,৮২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ও স্বনিয়োজিত ব্যক্তির শিরোনামে ছিল ৯,৮১১ কোটি টাকা। ১৯৮৯ সালের জুন মাসের শেষে এক থেকে পাঁচ কোটি টাকার একাউন্ট সংখ্যা ছিল ৭৭৬টি। জমা টাকার পরিমাণ ছিল ৪৫৫ কোটি। ’৮৮ সালের ডিসেম্বরে কোটি টাকার একাউন্ট ছিল ৬৩৬টি। মোট জমা টাকার একাউন্ট সংখ্যা ছিল ’৮৯-এর জুনে ৬৯টি এবং জমার পরিমাণ ছিল ৪৮২ কোটি টাকা। ’৮৮ সালে এই ধরনের একাউন্ট ছিল ৩৩টি এবং জমা ছিল ২২৭ কোটি টাকা। দশ কোটি ও তদুর্ধ্ব টাকার একাউন্ট ছিল ’৮৯-এর জুনে ২৪টি, জমা টাকার পরিমাণ ছিল ৪৫০ কোটি ৮৭ লাখ। দেড় বছর আগে ছিল ১৮টি ও জমা টাকার পরিমাণ ২৬৫ কোটি টাকা। এখানে উল্লেখ্য যে, ’৮২ সালে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ ছিল ২,৮০৬ কোটি টাকা। এ টাকার মধ্যে সরকারি খাতে জমা ছিল ৮৩০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি খাতে জমা ছিল ১,৪৩০ কোটি টাকা।”
এরশাদের আমলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়া সম্ভব ছিল না সর্বগ্রাসী লুটপাটের জন্য এবং তা হয়ওনি, যদিও সরকারি প্রচার মাধ্যমে অহরহ উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টার করা হয়েছে।
এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৮০-৮১ সালে উন্নয়ন বাজেটের ৩৫৪ শতাংশ আসতো বৈদেশিক সাহায্য থেকে, ১৯৮৮-৮৯ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১২৬.৩ শতাংশে। ঋণ দ্বারা ব্যাপকভাবে লাভবান হয় উচ্চ মধ্যবিত্তরা যার মধ্যে অন্তর্গত সামরিক-বেসামরিক আমলা ও রাজনীতিবিদরা। ১৯৭২-৮১ সালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৮৩, ১৯৮১-৮৯ সালে ২.৫৫ ভাগ। ১৯৮৪-৮৫ সাল থেকে ১৯৮২-৮৯ সালে খাদ্য উৎপাদন বাড়েনি। ১৯৭২-৮১ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৯৫ ভাগ। ১৯৮১-৯০ সালে গিয়ে দাঁড়ায় তা ৩.১৯ ভাগ। ব্যয় বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছিল সামরিক খাতে। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ দেখিয়েছেন- ১৯৮২-৮৮ সালে সামরিক খাতে প্রকৃত মূল্যে ব্যয় বেড়েছে ৯.৪ ভাগ। পুলিশ, আনসার ও বিডিআর খাতে ৫.৪ ভাগ। কারণ সহজেই অনুমেয়। সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীকে যাবতীয় সুযোগ দিয়ে ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করা।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এরশাদ আমলে আরো কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন কিছু উপাত্ত উদ্ধৃত করে যা প্রণিধানযোগ্য-
“সরকারি ব্যয় থেকে উপকার করা পাচ্ছেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠী সামাজিক খাতের ব্যয়ের মাত্র ২৪.৫ শতাংশ পেয়ে থাকেন, দরিদ্র নয় এমন জনগোষ্ঠী (৩০%) পেয়ে থাকেন ৬৫.৭ শতাংশ। অর্থনৈতিক খাতে রাজস্ব ব্যয়ের উপযোগিতা লাভের অনুপাত হলো ১৪.৬ ও ৭০.১ শতাংশ মাত্র। ভৌত অবকাঠামোতে এটি ১৬.৯ ও ৫৮.৬ ও প্রশাসন প্রতিরক্ষায় ১০.৬ ও ৭৩.০ শতাংশ মাত্র। উন্নয়ন ক্ষেত্রেও এ বৈষম্য লক্ষণীয়। সামাজিক খাতে ব্যয় থেকে দরিদ্রতম জনগোষ্ঠী ১০০ টাকার মাত্র ২০.৫ টাকা পরিমাণের উপকার পায়। দরিদ্র নয় এমন জনগোষ্ঠী পায় ৬৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক খাতে এ অনুপাত হলো ১৩.০ ও ৭১.৬, ভৌত অবকাঠামো খাতে ১৭.৫ ও ৬৬.৬ প্রশাসনে ১৩.৬ ও ৭২.৯ এবং অন্যান্য খাতে ১৯.২ ও ৬৩.৯। সরকারি ব্যয়ের অভিঘাত থেকে উপকারের অভিঘাত যে বিষয় সেটি পরিস্কার আর রাজস্ব আয়ের অভিঘাতও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিকূলে।”
অন্যভাবেও বিষয়টি দেখা যেতে পারে ১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সরকারি খাতে চুরি হয়েছে ১৭,৮৬৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এ তথ্য দিয়েছিলেন তৎকালীন (১৯৯৬) সরকারের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক।
দুর্নীতির কারণে চার্জশিট বেশি করা হয়েছে বেগম জিয়ার আমলে ৯২.৭৭ শতাংশ। দ্বিতীয় মুজিব আমলে ৬৮.৫০ শতাংশ। তবে, মনে রাখার বিষয় মুজিব আমল ছিল ৩ বছরের আর খালেদার আমল ৫ বছরের। সেদিক থেকে মুজিব আমলের পরিমাণ বেগম জিয়ার পরিমাণের প্রায় সমান সমান। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, বেগম জিয়ার আমলে চার্জশিটের একটি বড় পরিমাণ করা হয়েছে এরশাদ ও সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে। নিজের দলের বিরুদ্ধে নয়। শেখ মুজিবের কিন্তু সেই রাজনৈতিক সুবিধা ছিল না।
কারো বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করাটাই বড় কথা নয়। চার্জশিট আটোসাটো কিনা অর্থাৎ মামলায় টিকবে কিনা বা চার্জশিটের ফলে শাস্তি হবে কিনা সেটাও প্রাধান বিবেচ্য বিষয়। কারণ, চার্জশিটের কারণ যদি শাস্তিই না হয়, বা মামলাই না টেকে তাহলে চার্জশিট করে কী লাভ? এবার তা হলে সে হিসাব দেখা যাক।
মুজিব আমলে চার্জশিটের পর সবচেয়ে বেশি শাস্তি হয়েছে, ৪৭.৯৩ শতাংশ। সবচেয়ে কম জেনারেল জিয়ার আমলে ১৬.৮২ শতাংশ বেগম জিয়ার স্থান তার ওপরে ২২.৪৬ শতাংশ। এ হার জেনারেল এরশাদের শাসনামলের চেয়েও কম।
চার্জশিটের ফলে যে মামলা হয়েছে তাতেও দেখা যায় মুজিব আমলে শাস্তির পরিমাণ (অর্থাৎ হার) সবচেয়ে বেশি ৩২.৮৩ শতাংশ। সবচেয়ে কম জেনারেল জিয়ার আমলে ১০.৮২ শতাংশ, বেগম জিয়ার স্থান জেনারেল এরশাদেরও নিচে, তার স্বামীর ওপরে ২০.৮৪ শতাংশ।
এ উপাত্ত একটি বিষয়ই তুলে ধরে তা হলো, কলোনি ধারায় যারা শাসন করেছেন তারা জনস্বার্থে আগ্রহী নন যতটা আগ্রহী গোষ্ঠীস্বার্থে। জেনারেল জিয়া ও এরশাদ ছিলেন সামরিক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি, বেগম জিয়া ছিলেন পরোক্ষ।
বেগম জিয়ার প্রথম আমলের চিত্রও ঐ একই রকম। বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক বা উপনিবেশবিরোধী ধারায় ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ আমলের চিত্রটি দেখা যাক-
এ সময় পররাষ্ট্র থেকে সামাজিক নানা বিষয়ে উদ্যমী সাহসী সব পরিকল্পনা শুরু নেয়া হয়, কার্যকরও করা হয়, যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তি ও ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি, মিয়ানমারের সঙ্গে ভূমিচুক্তি, সামাজিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ও খাদ্য খাতের সম্প্রসারণ ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন।
১৯৯৬-২০০০ সালে, বাংলাদেশে খাদ্য শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ১৯০ লাখ থেকে ২৭০ লাখ টনে উন্নীত হয়। কৃষিঋণ বিতরণ পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে বার্ষিক ৬.৬%-এ উন্নীত হয়। মুদ্রাস্ফীতি পূর্ণাঙ্গভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশের সার্বিক সঞ্চয় (মোট জাতীয় উৎপাদনের ১৯%) ও বিনিয়োগ (মোট জাতীয় উৎপাদনের ২২%) বাড়ানো হয়। দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসরত জনগণের সংখ্যা ৫৩% থেকে ৪৪% এ নেমে আসে।
মানুষের মাথাপিছু আয় ২৮০ থেকে ২৮৬ ডলারে উন্নীত হয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে মানব দারিদ্র সূচক ৪১.৬ থেকে ২০০১ সালে তা নেমে আসে ৩২ শতাংশে। মানুষের গড় আয়ু ৫৮.৭ থেকে ৬২ বছরে উন্নীত হয়। বিএনপি আমলে সাক্ষরতা হার ছিল যেখানে ৪৪ শতাংশ শেখ হাসিনার সময় তা বৃদ্ধি পায় ৪৭ শতাংশ।
কৃষিক্ষেত্রে প্রবল উন্নতির প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে রক্ষার কৃতিত্ব দেখায় এই সরকার। নারীদের ক্ষমতায়নে সচেষ্ট থাকে। ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়ের কাজ শুরু করে বৈষম্যমূলক শত্রুসম্পত্তি আইন বাতিল করে এই প্রথম বারের মতো অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা ও মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মানে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। শুধু তাই নয়, প্রথম বারের মতো বয়স্ক ও বিধবা ভাতা ও গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
আওয়ামী লীগের পর জোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ২০০১-২০০৪-এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতার নীতি ত্যাগ করা বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন শৃঙ্খলা ও মানবাধিকারের এতো অবনতি আর কখনও হয়নি। খাদ্য শস্যের দামও বেড়েছিল।
নিত্য লড়াইয়ে শেখ হাসিনা : ১৯৭৫ সালের ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা অনেক সময় বলি, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়াটা যত সহজ ছিল, মুক্তিযোদ্ধা থাকাটা তত সহজ ছিল না। এর বলার অর্থ এই নয় যে, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়াটা খাটো করে দেখা হচ্ছে। এর কারণ ভিন্ন।
১৯৭১ সালে, আপামর জনসাধারণ [কিছু বাদে] ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। প্রত্যেকে তার সাধ্যমতো মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে। যারা অবরুদ্ধ দেশে ছিলেন তাদের ভূমিকা অনেক সময় খাটো করে দেখা হয়। অনেকে ভুলে যান, সীমান্ত যারা পাড়ি দিয়েছিলেন তাদের জন্য প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু ওঁৎ পেতে ছিল না। সবাই দেশ ত্যাগ করলে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতেন না। এছাড়া, দেশে অনেক বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। দেশে থেকেই তারা যুদ্ধ করেছেন। তাদের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না যদিও তা প্রায় ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে। এদের আমি বলি মুক্তিযুদ্ধের চতুর্দশ সেক্টর। দ্বাদশ সেক্টর স্বাধীন বাংলা বেতার, ত্রয়োদশ পৃথিবীর সিভিল সমাজ।
মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে শুদ্ধ আবেগ ও আদর্শের জায়গাটা ছিল অনেক বড়। তরুণ-ছাত্র-কৃষক, শ্রমিক বা সাধারণ মানুষ শুদ্ধ আবেগে কোনোকিছু পরোয়া না করে অস্ত্রহাতে তুলে নিয়েছিলেন। তারা কোনো পুরস্কার চাননি, পায়ওনি। পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি সৈনিকরা অনেকে যুদ্ধে গেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু, মনে রাখা বাঞ্ছনীয় আক্রান্ত বা বন্দি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা মনস্থির করতে পারেননি। কিন্তু সেটি অন্য বিষয়, মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকাও গৌরবোজ্জল। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়?
একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিক ও মেজর জিয়া যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। রফিক অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছেন, ২৫ মার্চ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে নেমে গেছেন। জিয়া অন্যদিকে সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানিদের জন্য অস্ত্র আনতে গিয়েছিলেন। পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে, রফিকের প্রণোদনায় যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং হ্যাঁ, কালুরঘাট থেকে ঘোষণা পাঠ করেছেন, যুদ্ধও করেছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত। রফিক নন। ১৯৭৫ সালের পর থেকে যারা জিয়ার হয়ে ক্ষমতা সংহত করেছেন তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেউ যুদ্ধে যাননি। বাধ্য হয়ে গিয়েছিলেন। পার্থক্যটা সেখানেই। ১৯৭৫ এবং তার পরবর্তীকালে সৈনিকরা যারা বিএনপি করেছেন তাদের সংখ্যা বেশি। যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গিয়েছিলেন তাদের প্রাণ হারাতে হয়েছে যেমন, খালেদ মোশাররফ, হায়দার ও হুদা।
প্রশ্ন উঠতে পারে সৈনিক নন এমন অনেক রাজনীতিবিদ বা পেশাজীবী কি বিএনপি করেননি? করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ করলেও। ধরে নিতে হবে, যুদ্ধে তারা গেছেন বটে কিন্তু আবেগ বা আদর্শ তাড়িত হয়ে নয়, বাধ্যবাধকতা ছিল বলে। ব্যতিক্রম যে ছিলনা তা’নয়, থাকবেই। কিন্তু, যারা বিএনপি করেছেন তাদের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে পর্যালোচনা করুন। যেমন, কূটনীতিবিদদের মধ্যে এপ্রিলেই যোগ দিয়েছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত শিহাবুদ্দীন, আমজাদুল হক আর মাহমুদ আলী। তারপরও অনেকে পক্ষ ত্যাগ করেছেন, এমনকী নভেম্বরেও। হোসেন আলীকেও অনেক সাধ্যসাধনা করে সুযোগ সুবিধা অক্ষুণ্ণ রেখে স্বপক্ষে আনতে হয়েছে। শিহাবুদ্দীন বা মাহমুদ আলীকে নয়। সুতরাং, এপ্রিল বা নভেম্বরে পার্থক্য থাকবে না, অবশ্যই থাকবে। স্বতঃস্ফূর্ত যোগ দেওয়া আর চুক্তি করে আনার মধ্যেও পার্থক্য থাকবে।
১৯৭৫ ছিল মূলত আদর্শের দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান, বাঙালি মানস বনাম পাকিস্তানি মানস। বিএনপি যদি পাকিস্তানি মানসে বিশ্বাস না করত তাহলে বঙ্গবন্ধুর করা মাইলফলক কার্যক্রম কেউ ছুড়ে ফেলত না। জামায়াত বা পাকিস্তানে বিশ্বাসী ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে জিয়া অবমুক্ত করেছিলেন সহযোগী হিসেবে। তাদের মূল বিষয়টাই ছিল, দেশ থাকবে কিন্তু তা হবে একটি মিনি পাকিস্তান। বলতে দ্বিধা নেই তারা বাংলাদেশে নিজেদের জন্য একটি শক্ত অবস্থান করে নিয়েছিল রাজনীতি ও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রে। গত তিন দশকে বাংলাদেশে তারা একটি আলাদা শ্রেণিও তৈরি করেছে যাদের আর্থিক বুনিয়াদও শক্ত। মিডিয়াতেও তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
১৯৭৫ সালের পর এককভাবে আওয়ামী লীগের অবস্থা ছিল নড়বড়ে। অনেকেই আদর্শচ্যুত হয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে তখন জোহরা তাজউদ্দীন, সাজেদা চৌধুরী প্রমুখ সেই অবস্থানটা ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত। অবাক লাগার কারণটা হলো রাজনৈতিকদলে পুরুষ আধিপত্য ছিল তখন প্রবল।
শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া একই সময়ে সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পটভূমি ছিল, ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, এমনকী খালেদা জিয়ার পুনর্বাসনেও ভূমিকা রেখেছিলেন। খালেদা জিয়ার কিছুই ছিল না। তবে, শাসক বা এস্টাবলিশমেন্ট ছিল তার পক্ষে। শেখ হাসিনার পরিচয় ছিল শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যা।
মিডিয়া ১৯৮২ সাল থেকেই খালেদার পক্ষ অবলম্বন করেছে। অর্থনৈতিক শক্তি ছিল তার পক্ষে। এস্টাবলিশমেন্ট তো বটেই। শেখ হাসিনাকে এর বিপক্ষে জায়গা করে নিতে হয়েছিল দল ও দেশের রাজনীতিতে। তিনি তখন আদর্শের জায়গাটিতেই জোর দিয়েছেন এবং এই আদর্শের জোরটাই বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে প্রবল পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। তার পক্ষে ছিলেন সাধারণ মানুষ যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। আর সমাজে অগ্রসরমান বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এদের সহায়তার প্রতি ইঞ্চি ভূমি তাকে লড়াই করে জিতে নিতে হয়েছে। আজ তিনদশক পর যদি ফিরে তাকাই তাহলে দেখব, শেখ হাসিনা যা করেছেন, পরবর্তীকালে তার চেয়ে বেশি কিছু করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
যখন শেখ হাসিনা ইঞ্চি ইঞ্চি জমি পুনর্দখল করছিলেন তখন মিডিয়া তাকে এবং খালেদাকে এক পাল্লায় মাপা শুরু করে। আমরা বলছিলাম, এই ধরনের মন্তব্য মতলববাজি। একজন বাঙালিদের জন্য লড়াই করছেন, আরেকজন পাকিস্তানের জন্য। আমি যদি বাঙালি হই, বাংলাদেশে বিশ্বাস করি তাহলে পাকিস্তানি মানসের প্রতিভূকে কিভাবে এক পাল্লায় মাপি? আজ তিনদশক পর বলতে হচ্ছে পাল্লা যদি কেউ মাপতে চান, একদিকের পাল্লা এত ভারি হবে যে মাপামাপিটাই ব্যর্থ হবে।
রাষ্ট্র, বাংলাদেশের আগেও অনেক গঠিত হয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো হবেও। রাষ্ট্র স্থাপন করা যত কঠিন তার চেয়েও কঠিন রাষ্ট্র বিরুদ্ধ শক্তি, তাদের আন্তর্জাতিক প্রতিভূকে পরাজিত করে রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিলেন, তারপর বলেছিলেন, এবার রাষ্ট্র রক্ষার দায়িত্ব। রাষ্ট্র রক্ষার অর্থ তার সীমান্ত অক্ষুণ্ণ রাখা নয়। এর অর্থ যে মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল তা অক্ষুণ্ণ রাখা। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্গত হবে না, সেদিক থেকে রাষ্ট্র অক্ষুণ্ণ, কিন্তু যখন রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ ছিন্নভিন্ন হয় তখন রাষ্ট্র বিপন্ন হয়ে পড়ে। পাকিস্তান যেমন। বাংলাদেশও ১৯৭৫ সালের আদর্শের জায়গাটা হারিয়েছিল। তা পুনরুদ্ধারে নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও এর নেতা শেখ হাসিনা এবং তার মিত্র কিছু মৃদু বামদল। সেই যে ১৯৮১ সালে ফিরে তিনি লড়াই শুরু করেছিলেন সে লড়াই এখনো চলছে, চলবে। তিনি না থাকলেও নতুন নেতৃত্ব যদি লড়াই চালিয়ে যায় তাহলেই বাংলাদেশ আবার পরিপূর্ণভাবে বাঙালির রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
শেখ হাসিনার লড়াইয়ের ফল : লড়াইয়ের শুরুতে শেখ হাসিনাকে নিজের দলে নেতৃত্বে দৃঢ় করতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর দল কী ছিল আর শেখ হাসিনা কী করেছিলেন আমাদের সমবয়সীদের জানা। সে বিত্তান্ত ঘাঁটতে চাই না। কিন্তু, এখন দলে তিনিই ক্ষমতার উৎস। সমষ্টিগত নয়, একক নেতৃত্ব।
দলকে পুনর্স্থাপনে তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই অগ্রসর হয়েছেন। গণতন্ত্রে প্রথম পদক্ষেপ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই যোগ দিয়েছে, নির্বাচন কমিশন ও সরকার ষড়যন্ত্র করবে জেনেও। কেননা, রাষ্ট্রে তাকে থাকতে হলে সেখানে তার একটি জায়গা করে নিতে হবে এবং সংসদীয় পদ্ধতিতে ফরে আসতে হবে। সেই লড়াইটা শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালেই জিতেছিলেন সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী করে। রাষ্ট্রপতি শাসন চালু হওয়ার পনেরো বছর পর দেশ সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। তার ২৫ বছর আমরা দেখছি সবধরনের রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষ দুটি বিষয় মেনে নিয়েছেন- ১. সংসদীয় রাজনীতি, ২. নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল। অনেক ব্যক্তি বা দল তা মানতে নারাজ হলেও এটি মেনে নিতে হচ্ছে। যে কারণে, নির্বাচনে না গেলেও নির্বাচনের কথাই বলছে বিএনপি এখন।
১৯৭৫ সালের একটি বড় বৈশিষ্ট্য খুনিদের খুন করার অবাধ লাইসেন্স বা দায়হীনতা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা পাকিস্তান ছাড়া আর কোথাও ঘটেনি। ১৯৭১ সালে যারা খুন করেছিল পাকিস্তান তাদের আশ্রয় দিয়েছিল [যেমন গোলাম আযম, নিজামী বা মুজাহিদ] উচ্চপদে বসিয়েছিল [ফরমান আলী বা অন্য কমান্ডারদের]। ১৯৭৫ সালে যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দুই-ই দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের খুনিরাতো ছিলই। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান থেকে তারা একধাপ এগিয়েও গিয়েছিল অর্থাৎ খুনিদের ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল সংবিধান সংশোধন করে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দায়হীনতা থাকতে পারে না। শেখ হাসিনা তাই ইনডেমনিটি বাতিলে সংবিধান করেছেন। এটি ছিল বড় একটি পদক্ষেপ। ইনডেমনিটি বাতিলের আগে কেউ ধারণা করতে পারেননি এটি বাতিল হতে পারে এবং অনেকে তা ভুলেও গিয়েছিলেন, মেনেও নিয়েছিলেন। শুধু ইনডেমনিটি বাতিল নয়, তিনি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগীদের খুনিদের বিচারও শুরু করেছিলেন। প্রতিশোধ বাসনা থাকলে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি করে বিচার করতে পারতেন। তা তিনি করেননি, বিচারের দীর্ঘপথই বেছে নিয়েছিলেন, অপরাধীদের শাস্তিও বিধান করেছিলেন।
দায়বোধ ফিরিয়ে আনার মানে এ নয় যে, সমাজে সবার ক্ষেত্রে দায়বোধ ফিরেছিল। কিন্তু, দীর্ঘদিন পর এ পদক্ষেপটি নেওয়াতে দায়বোধের বিষয়টি আবার আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছিল। এই রাষ্ট্রে কেউ আর এই বিচারের বিরোধিতা করার সাহস পাননি।
জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামে গৃহযুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন। সামরিক আধিপত্য বজায় রাখার এটি কৌশল। জাতিকে তিনি দ্বিধাবিভক্ত করেছিলেন আগেই, পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে তারপর তা ত্রিধাবিভক্ত করেছিলেন। জিয়া থেকে খালেদা জিয়া পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে সামরিক যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন। সেই শান্তিবাহিনীর সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের শান্তিচুক্তি করা ছিল জাতিগত বিদ্বেষ দূর করার প্রচেষ্টা। সেটি এখনো কতটা বিদ্যমান তা বিতর্কের বিষয় কিন্তু আন্তর্জাতিক মানেও যে এটি বড় বিষয় ছিল তা বলাই বাহুল্য। এর চেয়েও কম অবদান রেখে ওবামা থেকে অনেকেই নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।
শান্তিচুক্তি করার পর গঙ্গার পানিচুক্তিও ছিল শেখ হাসিানর প্রথম সরকারের একটি বড় ধরনের সাফল্য। সীমান্ত প্রতিবেশিদের বদলানো যায় না-এই সত্য মেনে সীমান্ত প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তিও একটি বড় পদক্ষেপ। আরেকটি বিষয় হলো, অর্ধশতকের পূর্বধারণা থেকে বা মাইন্ডসেট থেকে বেরিয়ে আসা। ৫০ বছর ধরে আমাদের একথাই বোঝানো হয়েছে যে, ভারত হিন্দু রাষ্ট্র, তাই মুসলমানদের মানে, আমাদের শত্রু। বাংলাদেশের অনেক মানুষ তা বিশ্বাস করতেন। তাই ভারতের সঙ্গে দুটি বিষয়ে সমঝোতা ছিল সাহসের ব্যাপার। কেননা, তা ছিল সাম্প্রদায়িকতা থেকেও বেরিয়ে আসার চেষ্টা। এ ঘটনা ঘটেছিল ১৮ বছর আগে।
খালেদা জিয়া তখনও বলেছিলেন, ফেনী থেকে খাগড়াছড়ি ভারতের হয়ে গেল। এও বলেছেন, হাসিনা ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলুধ্বনি হবে। একজন মহিলা, একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, একজন রাজনীতিবিদ হয়ে তিনি তখন থেকে যে ধরনের মিথ্যাচার করেছেন, ইসরাইলি কোনো রাজনীতিবিদও এমন মিথ্যা বলেননি। এ ধরনের মিথ্যাচার রাজনীতি নয়, মানুষকে বিভ্রান্ত করাও রাজনীতি নয়। এগুলো নষ্টামি। কিন্তু মনে রাখতে হবে আমাদের এলিট সমাজের বড় অংশ, যার মধ্যে মিডিয়াও অন্তর্গত, এই নষ্টামি পছন্দ করেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে সব ডানপন্থী একত্রিত হয়ে জোর করে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা ভুলে যাওয়া অপরাধ। পত্রিকা যাদের সুশীল সমাজ বলে বা এলিটরা, যারা কথায় কথায় রক্ষীবাহিনী ও ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কথা তোলেন, সেইসব ব্যক্তি কিন্তু ঐ পাঁচ বছরের অত্যাচার নির্যাতনের কথা বেমালুম ভুলে যান। না, এটিতে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাদের এইসব পদক্ষেপ বরং তাদের নষ্ট চরিত্র পরিস্ফুট করছে।
বিএনপির সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং যে অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, তাহলো গোলাম আযম-নিজামী বা জামায়াত বা ১৯৭১ সালের খুনিদের ক্ষমতায় বসানো। বিশ্বে এ ধরনের ঘটনা কখনো ঘটেনি। কিন্তু তাও এলিট ও মিডিয়া দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ মেনে নিয়েছিল। একটি বিষয় এখনো আমাকে অবাক করে, হয়তো আমি খানিকটা নির্বোধ দেখে যে, ২০০১ সালে যখন বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন দখল করল তখন বাংলাদেশে ১৩ জন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়নি। সেই ১৩ জনের মধ্যে ছিলেন কবীর চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অজয় রায়, বিচারপতি কে এম সোবহান, হাশেম খান, শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির প্রমুখ। এরপর সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষে রামেন্দু মজুমদার ও নাসিরুদ্দীন ইউসুফ একটি নমনীয় বক্তব্য দেন। আর কেউই নন। যারা এই প্রতিবাদটুকু করার সাহস দেখিয়েছিলেন যখন আওয়ামী লীগও হতবিহ্বল, তারা সরকারের আনুকূল্য পেয়েছেন, তা বলব না। অজয় রায়তো পুত্রহারা হইলেন। আমরা জেলে গেলাম। অধিকাংশ মিডিয়া সেই দখল হওয়া নির্বাচনের চরম প্রশংসা করেছে। এমনকি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যাদের খানিকটা আলাদা ভাবা হতো, তারাও উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেছে। হেনা দাস আমাদের বিবৃতিতে স্বাক্ষর করায় তাকে তিরস্কার করা হয় ও স্বাক্ষর প্রত্যাহার করানো হয়। এ কারণে বলি, এদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে হেজাবি লুকিয়ে আছে। আজ যেসব সাংবাদিক নেতা প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পান, তাদের কেউ মুরোদ দেখাতে পারেননি। স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করাতো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের স্যাবোটাজ। এটি কেন গ্রহণযোগ্য হলো গণতন্ত্রের নামে? আজকে যেসব খচ্চর নির্বাচনে গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে বলে বড় কথা বলেন, তাদের কেন তখন মনে হয়নি স্বাধীনতা বিসর্জিত হচ্ছে? এটি গণতন্ত্র নয়। এটি গণতন্ত্র হলে ইউরোপে নাজি দল অক্ষুণ্ণ থাকত, তাদের নির্বাচন করতে দেওয়া হতো। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে এসব অনাচার নষ্টামি প্রশ্রয় দিয়েছে সমাজের একটি বড় অংশ।
এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের প্রতিও চরম অপমান। তখনও অনেক বীর বিক্রমবীরের ভঙ্গি করে ১৯৭১-এর খুনিদের সঙ্গে কোলাকুলি করে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছেন। বাইরে আবার মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাহির করতে চেয়েছেন। আরও অবাক লাগে, আমরা না হয় নষ্ট হয়ে গেছি, দেখি এ খচ্চরগুলো পুষেছি কিন্তু তাই বলে নতুন প্রজন্ম! এখানেই আসে মনোজগতে আধিপত্যের কথা যা আমি বারবার লিখছি।
এদেরই বলেছি, বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাদের কাছে নিজের চামড়া বাঁচানোর জন্য নিছক যুদ্ধ মাত্র। অন্যান্য দেশে মানুষের বাচ্চারা চিন্তা করতে পারে না, খুনি বা মানবতাবিরোধীদের সমর্থন দূরে থাকুক, গণতন্ত্রের নামে এদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা। বাংলাদেশে তা ঘটেছে। নষ্ট মানুষ না বলে ঐসব খুনি ও তাদের সমর্থকদের সম্মান করা হয়েছে। কিন্তু এই নষ্টরাই তখন সব অধিকার হরণ করেছিল এবং এই নষ্টদেরই গণতন্ত্র রক্ষার নামে বন্দনা করেছে মিডিয়ার একটি বড় অংশ। যখন দেশের মানুষ মার খেতে খেতে বুঝল যে ঘটি-বাটি, স্ত্রী-কন্যা রক্ষা করা যাচ্ছে না তখন মিডিয়ার সেই সব পুরুষ, এনজিওর সেই সব বড় ভিক্ষুক, সুশীল ঠাকুররা হঠাৎ ‘নিরপেক্ষ’ হয়ে গেল। কিন্তু সত্য হলো, এই নষ্টামি, বাস্তবতায় এবং তা গ্রহণ করাতে পেরেছিলেন খালেদা-নিজামী। এটি মনোজগতে তারা গেঁথে দিতে পেরেছিলেন যে, ১৯৭১ এমন কোনো বিষয় নয় যার ভার বহন করতে হবে। এটি মনোজগতে গেঁথে দিতে না পারলে তো তাদের অস্তিত্ব থাকত না।
ঐ সময় তারা যে কাজটি করেছিল গণতন্ত্রের নামে, তাহলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলে দেওয়া এবং ১৯৪৭ সালকে ১৯৭৫ সালের সঙ্গে যুক্ত করা। পাকিস্তানি মানসের প্রধান বৈশিষ্ট্য আবার তারা ফিরিয়ে এনেছিল, আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল অর্থাৎ হিন্দুদের দালাল অর্থাৎ এরা ধর্মবিরোধী। এই মিথ্যা প্রচারে বড় ভূমিকা পালন করেছে মোল্লা-মৌলভি নামের তথাকথিত অর্ধশিক্ষিত ‘আলেমরা’ও। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ বা সেক্যুলারপন্থিদের দমনের জন্য ফ্রন্ট হিসেবে জঙ্গিদের সৃষ্টি করা হয়েছে সুচতুরভাবে। সরকারি উদ্যোগে বিরোধী দলের নেত্রীকে হত্যার চেষ্টা করেছে। নাজি জার্মানিতে এধরনের ঘটনা ঘটত।
ঐ পাঁচ বছরে তারা যা করেছিল, তাতে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা বা দলের পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল হতো। আওয়ামী লীগ বা হাসিনাকে তখন কোনো বিদেশি সরকার এমনকি ভারত সরকারও সমর্থন করেনি। কিন্তু শেখ হাসিনা দলকে ধরে রেখেছিলেন, নিজেও টিকেছিলেন স্রেফ আদর্শের জোরে। অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক শাসকরাও তাঁকে দমাতে পারেনি।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের জয় অনিবার্য ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত খালেদা-নিজামী-মইনের অত্যাচার ও লুটপাটে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকও অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল। কারণ তাদের কাপড়-চোপড় ধরেও তারা টানাটানি করছিল। তারা যদি সেই সব কাপড় চোপড় ধুয়ে টুয়ে গরিবদের অধিকার স্বীকার করত তাহলে হয়েতো তারা টিকে যেত। কিন্তু ঐ কাপড়-চোপড় লুটে নিজেরাই পরতে চেয়েছিল। ফলে বিএনপি-জামায়তরা এমনভাবে পরাজিত হলো যে, দল হিসেবে টিকে থাকাও কষ্টসাধ্য ছিল। ঠিক তখনই যদি শেখ হাসিনার প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতেন তাহলে অনেকেরই গোলাপি নেশা টুটে যেত। কিন্তু মুখে শেখ হাসিনা যত কিছুই বলেন, অপার নিষ্ঠুরতা তিনি তেমনভাবে দেখাতে পারেননি। বরং যারা ভুলত্রুটি স্বীকার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেননি মনোভাবেও।
এই প্রতিশোধ না নেওয়ার কারণেই পরবর্তীকালে আরও কয়েক দফা বিএনপি-জামায়াত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সন্ত্রাস চালিয়ে যেতে পেরেছে। হাসিনা যখন কঠোরভাবে জঙ্গি সন্ত্রাস দমন করেছেন, তখন আবার আন্তর্জাতিক সমর্থন ফিরে পেতে থাকেন। কারণ পাশ্চাত্য এবং অনেক জায়গায় ধর্মের নামে সন্ত্রাসের সংখ্যা বাড়ছিল। নিজেরা সন্ত্রাসের শিকার হওয়ায় তারা অনুধাবন করতে পেরেছিল কিছুটা যে, সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল সমর্থন করা যায় না। কিন্তু নষ্ট মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে এখনো সন্ত্রাসের স্থান আছে। যারা জামায়াতকে এখনো মডারেট ডেমোক্র্যাটিক পার্টি মনে করে, ২০১৩-১৪ সালের সন্ত্রাসকে সমর্থন দেয়, তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করলে যে আখেরে পস্তাতে হবে, এটি আমাদের রাজনীতিবিদ ও আমলাকুলকে অনুধাবন করতে হবে।
জঙ্গিবাদ নির্মূল ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বর্তমান সরকার শুরু করেছিল। এটি আমার পর্যবেক্ষণ, ভুলও হতে পারে যে, শুরুতে এ বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগেও মতভেদ ছিল। শেখ হাসিনা দলের ও সরকারের নেতৃত্বে না থাকলে এ বিচার যে হতো না, এ ব্যাপারে আমরা অনেকেই নিশ্চিত। এটি একটি আদর্শগত অবস্থান। একইসঙ্গে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমেও যে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো সংবিধানে সংযোজন করেছেন, তাও একটি অর্জন। অনেকে বলেন, হ্যাঁ, আমরাও বলি যে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে তার সঙ্গে চারনীতি বলবৎ করা সাংঘর্ষিক। বাস্তবটা হচ্ছে, আমরা যারা একথা বলি, তারাও তো এর পক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টি করতে পারিনি। আরও বাস্তব হচ্ছে, শেখ হাসিনা আদর্শের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতিও করেন। তিনি ভোটের রাজনীতি করেন। আমাদের অবস্থানটা এখানে আদর্শগত তো বটেই, আবেগজাতও।
এক্ষেত্রে তার সঙ্গে একটি আলোচনার কথা মনে পড়ছে। যদিও প্রসঙ্গটি ব্যক্তিগত। কিন্তু যে প্রসঙ্গ আলোচনা করছি সে প্রসঙ্গে এটি বলা যেতে পারে। জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি আমাদের অনেকেরই মনঃপূত নয়। এমনকি রেনিগেড রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও সমঝোতা নয়। তিনি নির্বাচনের আগেই বলেছিলেন [১৯৯৬] হ্যাং পার্লামেন্ট হবে। ‘কম খারাপের সঙ্গে যদি সমঝোতা না করি আমি ক্ষমতায় যেতে পারব না। জামায়াত-বিএনপি তো আরও খারাপ। তাদের সঙ্গে কি সমঝোতায় যাওয়া সম্ভব? আর আমি ক্ষমতায় না গেলে কি আপনাদের দাবিপূরণ করা যাবে?’ একথা বলা বাহুল্য, উত্তর দিতে পারিনি। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় না গেলে রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্তগুলো নিতে পেরেছেন শেখ হাসিনা- তা কি সম্ভব হতো?
পদ্মাসেতু নিয়ে যে কাণ্ড হলো তা ছিল সুপার পাওয়াররা যা চায় দুর্বল দেশ তা মেনে নেবে কি নেবে না তার পরীক্ষা। এই দ্বন্দ্বে আমরা জিততে না পারলে আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হতো না। কিন্তু শেখ হাসিনা সে সাহস দেখিয়েছিলেন। ১৯৭১-৭২ সালে সে সাহস দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ। হ্যাঁ, তার ফল প্রথমোক্ত দুজন ভোগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডিকটাট শেখ হাসিনা মানেননি, এটি যুক্তরাষ্ট্রের এস্টাবলিশমেন্ট কখনো ভুলবে না। তারা প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপ করেননি। শুধু তাই নয়, নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির উদ্যোগও বিশ্বব্যাংকের বিপরীতে চীনের নেতৃত্বে যে ব্যাংক গড়ে উঠছে, তাতে যুক্ত হওয়া সাহস ও প্রজ্ঞার ব্যাপার। কারণ এ শতাব্দী হবে এশিয়ার। ইউরোপ বা আমেরিকার নয়। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ও সমুদ্র নিয়ে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। ১৯৪৭ সাল থেকে ধরলে প্রায় ৭০ বছরের। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বও সমাধান করলেন শেখ হাসিনা। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত দ্বন্দ্ব আগেই মিটিয়েছিলেন। তারপর সমাধান হলো সমুদ্র বিরোধের। এ জয় অপ্রত্যাশিত। তেমনি অপ্রত্যাশিত ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বা সীমান্ত এবং সমুদ্রদ্বন্দ্বের সমাধান। ভারত যদি সমুদ্রদ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য সালিশি আদালতে না যেত, তাহলে বাংলাদেশের করার কিছুই ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনার কারণে ভারত রাজি হয়েছিল। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়ন হবে এটি কেউ ভাবেননি। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বও ৭০ বছর পর শেখ হাসিনাই নিরসন করেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমান্ত এভাবে তিনি শুধু নির্ধারনই নয়, সংরক্ষণও করেছেন।
দুঃখিনী শেখ হাসিনা॥ দুঃখ অতিক্রমের লড়াই : শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার মতো দুখিনী বাংলাদেশে আর কেউ নেই। আমি অনেক সময় বলি ফেমিনিস্ট মনোভঙ্গির বিরোধী হয়ে যে, বাংলাদেশে যদি সিংহ পুরুষ ও সিংহ হৃদয় কারো থাকে তবে তা শেখ হাসিনার। পরিবারের একজন বা দু’জন এক সঙ্গে মারা গেলে পাগল পাগল লাগে। এখন ভাবুন ১৯৭৫ সালের কথা। ভাবুন, তরুণী শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা যাচ্ছেন বরের সঙ্গে দেখা করতে জার্মানি। সঙ্গে বালিকা, ছোট বোন শেখ রেহানা। শেখ হাসিনা কয়েকদিন আগেও বলেছেন, তিনি যেতে চাননি। মন চায়নি যেতে। গেছেন। জার্মানিতে থিতু হতে না হতেই খবর পেলেন পরিবারের কেউ নেই। তিনি রাষ্ট্রপতির কন্যা নন তখন, কিন্তু জাতির পিতার কন্যা তো বটে। কিন্তু যে রাষ্ট্রদূত আমলা তাকে বিমানবন্দরে রিসিভ করার জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছেন। কেউ আর তাঁকে চেনেন না হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ছাড়া। তিনি তাঁকে ভারত পাঠাবার বন্দোবস্ত করেন। ইন্দিরা গান্ধী ওয়াজেদ মিয়াকে চাকুরি দেন। শেখ হাসিনা ছোট একটি ফ্ল্যাটে রান্না বান্না থেকে শুরু করে সব করতেন। শেখ রেহানা এখানে সেখানে। তারপর আমার বন্ধু শফিকের সঙ্গে তার বিয়ে হলে তারা থিতু হন।
শেখ হাসিনা মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন কীভাবে! তিনি ও রেহানা পাগল হননি কেন? শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান তাকে ঢাকায় আসতে দেবেন না। যখন দিতে বাধ্য হলেন, তখন আবার সব ছেড়ে ঢাকায় আসার সাহস পেলেন কীভাবে? পেলেন তো পেলেন এসে আওয়ামী লীগের মতো একটি দল ফের পুনর্গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হলেন। তারপরের জীবনতো দেখা। এ শুধু তাই নয়, পিতার মৃত্যু থেকে এ পর্যন্ত ২২ বার তাকে হত্যার প্রচেষ্টা হয়েছে। খালেদা জিয়া বা এরশাদ বা নিজামীর [যখন ছিলেন] ওপর তো কোন হত্যা প্রচেষ্টা হয়নি। এর অর্থ, বাঙালিদের বুকের মধ্যে পাকিস্তানের একটি ডাকটিকেট এখনও রয়ে গেছে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, শেখ হাসিনার জন্য যদি কেউ এক ছটাক করে থাকেন বা বঙ্গবন্ধুর জন্য, সেই কেউ পরে অন্য রাজনীতি করলে এমনকী দুর্বৃত্ত হলেও শেখ হাসিনা সেই এক ছটাকের কথা ভোলেন না। তার জন্য কিছু না কিছু করেন। বাবার জিন পেয়েছেন তিনি। বাবার অফুরন্ত দোয়াও। বঙ্গবন্ধু তার ‘হাচু’কে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসতেন। না হলে ২২ বার কেউ হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বাঁচতে পারে না।
এলেন, দেখলেন জয় করলেন- এ ভাগ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু বা তাঁর কন্যা জন্মগ্রহণ করেননি। এ রাষ্ট্র নির্মাণে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে আত্মত্যাগ শুধু নয়, রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁর দল ও বিরোধীদের থেকে এবং নিজ (পরিবারেরও) প্রাণ দিয়ে তিনি তার মূল্যও দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তখন তার নিকটজন কেউ এদেশে ছিলেন না স্বামী ছাড়া। বিশ্বাস করার মতো লোকও ছিল না। জেনারেল জিয়া তাঁকে দেশে আসতে দিতে বাধ্য করেছিলেন। এরশাদ পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। সেই আমল থেকে এ পর্যন্ত তাঁকে বারবার মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়েছে।
এরশাদ আমলে প্রথম তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে এরশাদ পুলিশের সাহায্যে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে। ঐ দিন সেখানে ৮ দলের এক সমাবেশ ছিল। মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে শেখ হাসিনা সমাবেশস্থলে যাচ্ছিলেন। বিনা উস্কানিতে পুলিশ, আর্মড পুলিশ আর বিডিআর মিছিলের ওপর গুলি চালায়। ১১ জন সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন, আহত হন ৫৬ জন। ঐ ৫৬ জনের মধ্যে পরে আরও অনেকের মৃত্যু হয়। এটি চট্টগ্রাম হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। এ নিয়ে মামলা হয়েছিল। সে মামলার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। শেখ হাসিনাও সে মামলার নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নেননি। যারা তাঁর জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের হত্যার বিচারটা তাঁর আমলে হওয়া কি জরুরি নয়?
খালেদা জিয়া ও নিজামীর আমলে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালানো হয়। এতবার চেষ্টা হয়েছে যে তার সংখ্যা আর মনে নেই। সবচেয়ে বড় চেষ্টা ছিল টুঙ্গিপাড়া ও গুলিস্তানে। গুলিস্তানে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য খালেদা ও তার পরিবার এবং গোয়েন্দা সংস্থা সরাসরি জড়িত ছিল। তিনি প্রাণে বেঁচেছেন। মৃত্যু হয়েছে অনেকের। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে। কোনো মামলাই নিষ্পত্তি হয়নি। এটি গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাপার নয়। হয় শেখ হাসিনার আইনমন্ত্রীরা এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না বা এখনো নন। আমরা মনে করি, তাঁর জন্য তাঁর যে সমর্থক ও কর্মীরা প্রাণ দিয়েছেন তাদের বিচারগুলোর নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। এটি উপেক্ষা করা তার মাপের মানুষের জন্য বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা এর সূত্রে এই রাষ্ট্রের বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের ধারাটা উন্মোচিত হবে।
শেখ হাসিনা যতবার ক্ষমতায় থেকেছেন, ততবারই তাঁকে অজস্র প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এদেশের সামরিক, বেসামরিক আমলা কুলের এবং এলিটদের আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি গোপন একটি বিদ্বেষ ভাব আছে। ২০০৭ সাল থেকে প্রতিকূলতার সম্মুখীন তাঁকে বেশি হতে হয়েছে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তারপর খালেদা-নিজামীর জ্বালাও-পোড়াও সন্ত্রাসের রাজনীতি। হেফাজতের ঢাকা দখল চেষ্টা। মিডিয়ার বিরুদ্ধাচরণ। আন্তর্জাতিকভাবে বিরুদ্ধাচরণ। সব প্রতিকূলতা তিনি মোকাবিলা করেছেন এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো আবার পুনর্স্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু এই রাষ্ট্র গঠন ও তার কাঠামো নির্মাণ করে দিয়েছিলেন, তাঁর কন্যা তা দৃঢ় করেছেন।
সবচেয়ে বড় কথা, গত প্রায় ৪৫ বছরে শেখ হাসিনার সময়ই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি কি শুধু শুধু না সঠিক অর্থনৈতিক নীতিগ্রহণ ও প্রণোদনার কারণে। বাংলাদেশ এখন যত সমৃদ্ধ গত ৫০০ বছরে তত সমৃদ্ধ ছিল না। খুব শিগগিরই তা মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত হবে। এটিও ভেবে দেখা দরকার, কেন সামরিক এবং বাংলাদেশ বিরোধীদের আমলে বাংলাদেশ সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। গত ৯২ দিন দেশের বিরুদ্ধে অবরোধ-হরতাল চালিয়েও খালেদা কিছু করতে পারেননি।
আলোচনা-সমালোচনা : বাংলাদেশে শেখ হাসিনার মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউ পাননি। এ নিয়ে আমরা গর্বিত। কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে এটিও জানি, নিজের দেশে আসন পোক্ত না হলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে কিছু আসে যায় না।
রাজনৈতিক দলও টিকে থাকে কখন যখন সেই দল নিজেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সময়োপযোগী করে তোলে, তরুণদের আকৃষ্ট করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টির কথা ভাবুন। আওয়ামী লীগ কি নিজেকে সময়ের সঙ্গে উপযোগী করে তুলছে। এর উত্তর আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদেরই দিতে হবে।
শেখ হাসিনার সমালোচনা হবে। পাবলিক ফিগার হলেই আলোচনা-সমালোচনা হবেই। সেটি মেনে নিতে হয়। ক্ষমতার জোয়ার সব সময় ভালো নয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে রাখতে হবে, ছাত্রলীগ- যুবলীগের বাইরেও এক বিরাট তরুণ সমাজ আছে। আওয়ামী লীগের বাইরের মানুষই সংখ্যা গরিষ্ঠ।
আওয়ামী লীগ আমলে বা শেখ হাসিনার আমলে সব সমস্যার সমাধান হয়েছে এমন বলব না। আমলাতান্ত্রিক শাসন জোরদার হয়েছে। একটি উদাহরণ দিই।
আগে সর্বোচ্চ বেতনকাঠামো অর্থাৎ ৪০ হাজার টাকায় আমলা-শিক্ষকরা সবাই ছিলেন। বর্তমান পে-স্কেলে শিক্ষকদের অবস্থান চতুর্থে। এই একটি বিষয়ই প্রমাণ করে আমলাদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামরিক-বেসামরিক আমলাকুলের আধিপত্য ভবিষ্যতের জন্য শুভ নয়। আমরা কি পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাঙালিদের শাসন দেখিনি!
আওয়ামী লীগ দল হিসেবে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলে থাকলে তারা যত আদর্শগতভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকে, এখন সে অবস্থানেই। বিএনপির মতো সুবিধাবাদীদের প্লাটফর্মে দলটি পরিণত হলে শেখ হাসিনা যে অর্জন করেছেন, সে অর্জন ধরে রাখা যাবে না। শুধু তাই নয়, এতে সাফল্য নেতা বা নেতাদের বিচ্ছিন্ন ও একনায়কী করে তোলে। এটি ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য শুভ নয়। আগামী দিনের দল ও নেতৃত্ব তাই নিজস্বার্থেই এখন থেকেই নির্মাণ করা বিধেয়। এখনো অনেকে দুই নেত্রীকে একত্রে দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু দিনদিন সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আরও হবে। যারা গোলাপি নেশায় বুঁদ হয়ে, হেজাবি চরিত্র নিয়ে ভাবছেন আগের মতো একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবেন, তা বোধহয় হবে না।
তবে একটি কথা মানতে হবে, যা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের প্রতিফলিত হয়েছে, তাহলো, আমাদের মনোজগতে হেজাবি আধিপত্য একেবারে বিনষ্ট হয়নি। কমপক্ষে ৩৫ ভাগ লোকের মনোজগতে যে তারা আধিপত্য বিস্তার অক্ষুণ্ণ রেখেছে, এটি তাদের বিপুল সাফল্য। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা সাফল্য দেখাতে পারেননি। কেন পারেননি বা কেন আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছেন না, তা আমার মতো ছোট মাপের মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মনোজগতে যদি বাঙালিত্বের আধিপত্য না ঘটে, তাহলে এইসব যুদ্ধ ও অর্জন বৃথা যাবে। শুধু উন্নয়ন মানুষের মনের নষ্টামি দূর করে না।
শেখ হাসিনা নষ্টদের থেকে সবকিছু এখনো নিজের অধিকারে আনতে পারেননি। হয়তো পারবেনও না। দুটি জেনারেশন এই বিকৃতরোগে আক্রান্ত। কিন্তু যে লড়াইটা তিনি শুরু করেছিলেন, তা শেখ হয়নি। এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে না। তা এখনো চলছে। যে সাফল্য তিনি অর্জন করেছেন, তা এখন সংহত করার সময়। সেজন্য লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে।
শেখ হাসিনার বিরোধীরা যে এখন আরও জমি হারাচ্ছে, তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মিডিয়ার যে অংশ তাঁর বিরুদ্ধে সবসময় তৎপর, তারা এখন হঠাৎ নমনীয় বলবনা, কেমন যেন নিরপেক্ষ। মতলববাজরা কখন কী করতে হবে, তা আগেই বোঝে। খুব সম্ভব পরিস্থিতি এখন আর হেজাবিদের অনুকূলে নয়। নতুন কম্পিউটার জেনারেশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হেজাবিদের বিরুদ্ধে। হেজাবিদের পক্ষে থাকা এখন মডার্নিটি বা স্মার্ট নয়। সেকারণেই তারা নিরপেক্ষ হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে পরানের গহীন গভীরে একটুকরো হেজাবি তারা সযত্নে লুক্কায়িত রাখবে।
লন্ডনে শেখ হাসিনার ভাগ্নি, শফিক-রেহানা কন্যা টিউলিপ সংসদ নির্বাচনে জিতেছেন। এসব ঘটনাও কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে প্রভাবিত করে। কারণ, বাঙালিদের মধ্যে ট্রাইবাল মনোভাব এখনো প্রচুর। টিউলিপের জেতাটা টুঙ্গিপাড়া থেকে জেতার চেয়েও ছিল কঠিন। গ্লেন্ডা জ্যাকসনের মতো ডাকসাইটে মহিলা মাত্র কয়েক ভোটে সেখানে জিতে ছিলেন। টিউলিপ সেই ভোটের পরিধি বাড়িয়ে জিতেছেন। কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যানের সম্পাদক মানস ঘোষ আমাদের ফোন করে উল্লসিত স্বরে বললেন, দেখলেন কী হলো? হাসিনার ভাগ্নি জেতে আর খালেদা জিয়ার পুত্র পাঁক ঘাঁটে। কেন এমন হয়? উত্তরে বললাম, পাঁকে পদ্মফুল ফোটার কথা বলা হয় বটে, কিন্তু যারা পাঁকে বড় হয় পাঁক ঘাঁটা তাদের স্বভাবই হয়ে দাঁড়ায়। আমগাছে কি আম হবে না গাব? গাব গাছে কি আম ধরবে- যতই যত্ন নেন না কেন গাব গাছের।
এর কারণ পেডেগ্রি। বংশের ব্যাপারটা বা নাগরিক বৈদগ্ধের কথাটা আগে খুব একটা মানতাম না। এখন খানিকটা হলেও মানি। দুতিন জেনারেশনের শিক্ষিতের সঙ্গে প্রথম জেনারেশনের শিক্ষিতের একটা বড় তফাত হয়েই যায়। আর যার কোনো জেনারেশনই শিক্ষিত নয়, তার কথা কী বলব? দুজনের চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গিতেই প্রবল পার্থক্য দেখব। বিশ্ববিদ্যালয়েই তো দেখছি।
শেখ হাসিনা রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন। এমন একটি পরিবার, যেখানে আত্মত্যাগের ও আদর্শের প্রতি অনুগত থাকার একটি ঐতিহ্য আছে। রাজনীতি সচেতন তিনি এবং পূর্ব ঐতিহ্যের কারণে যতটা সম্ভব আদর্শের প্রতি অনুগত থাকার চেষ্টা করেন।
তাঁর পরিবারের আত্মত্যাগের একটা ইতিহাস আছে। বৃহত্তর সমাজ কিন্তু এগুলো মনে রাখে। খালেদা জিয়া সুবিধাভোগী ক্ষমতা লোভী সামরিক আমলা পরিবেশেই বড় হয়েছেন। যেখানে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়টাই মুখ্য। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পুত্র-কন্যাদের গরিবি হালে কষ্ট করে শিক্ষিত হতে হয়েছে। খালেদার পুত্ররা বৈভব থেকে এবং রাষ্ট্রীয় খরচে বড় হয়েও শিক্ষিত হননি, বরং ড্রাগ এডিক্ট ও লুটেরা হয়েছেন।
টিউলিপের পিতা আমার সহকর্মী ও বন্ধু। কী অবস্থায় তার পরিবার প্রতিপালিত হয়েছে, আমি জানি। টিউলিপ যে ভোটে জিতেছেন তার কারণ, তাকে সব অর্জন করতে হয়েছে, রাজনীতি সচেতন হয়েছেন, প্রতিপক্ষকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরাভূত করতে উদ্যত হননি পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কারণে। তারেক রহমান বঙ্গবন্ধু থেকে এমন কেউ নেই যাকে প্রতিনিয়ত গালিগালাজ করেননি। কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করেছেন এবং তিনি কী ধরনের পরিবার থেকে এসেছেন তা পরিস্ফুট করেছেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, তারেকের অনুসারীরা সেই লন্ডনেও টিউলিপকে নোংরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হারাবার চেষ্টা করেছেন। কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। নষ্ট রাজনীতি ও নষ্টামির মধ্যে যে বড় হয়, সে নষ্টই থাকে এবং তাকে নষ্টরাই সমর্থন করে। কিন্তু সেই সুদূরেও টিউলিপকে বিএনপি-জামায়াত বেকায়দায় ফেলতে পারেনি।
এ রকম নেতা ও নেতৃত্ব যারা সমর্থন করে, তারা শুধু গোলাপি নেশায় মত্ত তা নয়, নষ্টদের অধিকার তারা ফেরত আনতে চায়, যেখানে তাদের পরিবৃদ্ধি। একটি উদাহরণ দিই। পৃথিবীর কোথাও মানবতাবিরোধীদের কেউ সমর্থন করেনি, করে না। বিএনপি করেছে পাকিস্তানি মানসের কারণে এবং সেই একটি কারণে তার রাজনীতিই বন্ধ করে দেওয়া উচিত, জামায়াতের তো বটেই। জঙ্গিবাদ সমর্থন এবং গত একবছর তারা যে সন্ত্রাস চালিয়েছে সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সেখানে তাদের নিছক সন্ত্রাসী ছাড়া অন্যকিছু ভাবা বিধেয় নয়।
তারপরও মিডিয়ার একটি অংশ, এনজিওর একটি অংশ, এলিটদের একটি অংশ যখন গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্র চর্চার নামে এদের সমর্থন করে তখন বলতে হয়, এরাও নষ্ট রাজনীতির অন্তর্গত। নাহলে এই স্লোগান কেউ তোলে না যে, আওয়ামী লীগ জিতলে সব শেষ, বিএনপি জিতলে সব ঠিক। বা, ড. এমাজউদ্দীনের মতো বলতে হয়, গত ৪৩ বছরে তিনি এমন খারাপ নির্বাচন দেখেননি, যা তিনি সিটি নির্বাচনে দেখেছেন। এদের মতো মানুষজনই একজন অর্ধশিক্ষিত, সংস্কৃতিহীন যুবককে নেতা বলে মেনে নেয়। কারণ, তাদের আর যাই থাকুক চরিত্র বলতে কিছু নেই। বস্তুগত কিছু পাওয়াই তাদের একমাত্র অভীপ্সা।
আওয়ামী লীগ ধোঁয়া তুলসী পাতা নয়। তারা এবং তাদের সরকার যা করে, তার সবকিছু গ্রহণযোগ্য নয়। নববর্ষে মহিলাদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করলে মহিলাদেরই এখন লাঠিপেটা করা হয়, সেক্যুলারিস্টদের হত্যা করলে যখন তদন্ত শ্লথ হয়ে যায়, সুবিধাবাদী লোকগুলো যখন সরকারের আনুকূল্য পেতে থাকে, তখন বিতৃষ্ণাই জাগে। সরকার ও আওয়ামী দলে হেজাবিদের সংখ্যা খারাপ নয়। আওয়ামী লীগ নেত্রী বা তার সম্পাদক বলেন, জামায়াতকে এক বিন্দু ছাড় দেওয়া হবে না। শেখ হাসিনা বলেছেন, এমন আকাল পড়েনি যে আওয়ামী লীগে জামায়াত কর্মী নিতে হবে। সেখানে দলের যুগ্মসম্পাদকই জামায়াতের নেতাকর্মীদের সস্নেহে বাহুডোরে আবদ্ধ করে দলে নেন। স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী নেতারা হেজাবিদের আনুকূল্য দিতে ভালোবাসেন। হেজাবিদের জন্য তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখলে অভিভূত হবেন। দেশে সুশাসনের সুবাতাস বইছে, এমন কথাও বলব না।
কিন্তু এই রাষ্ট্র গঠন হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এ রাষ্ট্র যখন তার মৌলিকত্ব হারাচ্ছিল এবং রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছিল, তখন শেখ হাসিনা সেই রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব ফিরিয়ে এনেছেন অনেকটা এবং ব্যর্থ রাষ্ট্র থেকে তা সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রে পরিণত করার কৃতিত্বও আওয়ামী ও শেখ হাসিনার। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিকক্ষেত্রেও মতৈক্য হয়েছে। যে কারণে বিএনপি-জামায়াতের এক সময়ের মিত্র বিজেপি ও শেখ হাসিনার সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের চুক্তি মেনে নিয়েছেন। অথচ, নরেন্দ্র মোদির বিজয়ের পর বিএনপি-জামায়াতিরা মিষ্টির দোকান খালি করে দিয়েছিল। বিএনপি যে নষ্ট রাজনীতির প্রতীক তার সর্বশেষ উদাহরণ ছিটমহল চুক্তি ভারতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর খালেদা জিয়া মোদিকে অভিনন্দন জানালেন এবং হাসিনাকে ভারতের দালাল বললেন। কী রাজনীতি! এই বেগমকে কেউ বুঝিয়ে বলেনি, দালালি যদি করতেই হয় তাহলে বিজয়ী ও সফল রাষ্ট্রের দালালি করাটাই ইতিবাচক বা বুদ্ধিমানের কাজ। আর শেখ হাসিনাকে যখন দালাল বলছেন, তখন সেই প্রভুকে এত তোয়াজ করছেন কেন? দালালি পাওয়ার জন্য? কিন্তু যিনি পরিচিত আজীবন পরাজিত ব্যর্থ ও নষ্ট রাষ্ট্রের দালালই শুধু নয় প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যখন অন্য কাউকে একই অভিধায় ভূষিত করেন তখন বোঝা যায় চারদিকে ভূমি হারাচ্ছেন তিনি। নষ্ট চরিত্রের মানুষই নষ্ট পরাজিত পশ্চাৎপদ ব্যর্থ হিংস্র রাষ্ট্রের পদলেহন করে। সেই আদর্শ এদেশে প্রোথিত করতে চায়।
এই নষ্টামি, পাকিস্তানি মানসের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তা এখনো শেষ হয়নি। সেটি চালাতে হবে অবিরাম, চলবে। নিরন্তর লড়াইয়ের ফলেই আজ শত্রুর বিষদাঁত ভেঙেছে মাত্র। মরেনি সে। তাই লড়াই চলবে। সংখ্যা গরিষ্ঠ যখন ১৯৭১-এর মতো মনে করবে লড়াইটা সঠিক, লড়াইটা পাকিস্তানি বাঙালিদের নষ্টামির বিরুদ্ধে, হেজাবিদের ভন্ডামির বিরুদ্ধে তখনই আমরা খানিকটা বিশ্রাম নিতে পারব এই ভেবে যে, আমরা লক্ষ্য অর্জন করেছি। কিন্তু এপ্রসঙ্গে একটি কথা বলা জরুরি। বারবারই তা বলে আসছি।
এবার দুটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যে ফলাফল তা আমাদের হতাশ করেছে। এতো সন্ত্রাস, হত্যার পরও পাকিস্তানি বাঙালিরা যে ভোট পেয়েছে তা শঙ্কার কারণে। শেখ হাসিনা বা তার সরকারের এত অর্জন ও মাইন্ডসেট পরিবর্তন করতে পারেনি। এর অন্য অর্থ, খালেদা-নিজামী রাজনৈতিক অর্থে জিতেছেন। গত তিন দশকে তারা বাংলাদেশের ৩০ ভাগ মানুষের মগজে পাকিস্তান গেঁথে দিতে পেরেছেন। বাকি ৫০ ভাগের মধ্যে পাকিস্তান ভালোবাসা না থাকলেও হেজাবি মনোভাবটুকু কিছু না কিছু রয়ে গেছে। শেখ হাসিনা যে কারণে লড়াই করে যাচ্ছেন অন্তিমে কী তাহলে ফলদায়ক হবে?
উন্নয়ন ভোটের জন্য জরুরি। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নও দরকার। না হলে শেখ হাসিনার যে সাফল্য তা অনুধাবনেও তারা ব্যর্থ হবে। বর্তমান সরকার উন্নয়নের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে তা স্বাভাবিক। কিন্তু জিডিপির উন্নয়ন মানে সব মানুষের উন্নয়ন নয়। হলে, হাজার হাজার মানুষ এখন অভিবাসী হওযার জন্য সাগরে ভেসে বেড়াত না। স্রোতের মতো মানুষ দেশত্যাগ করতে চাইছে। এ বিষয়টাও কিন্তু ভেবে দেখা দরকার।
রাজনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার রাজনীতি বা বাঙালিত্বের লড়াইয়ের বিষয়টা নতুন জেনারেশনের মনে প্রোথিত করতে হবে। মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করতে হবে। আমরা বারবার বলছি, যে শিক্ষা নিয়ে সবাই বলছে সফলতা আসছে, তা ঠিক নয়। আমরা যা বলি তা সঠিক নয় বা জানিনা এই দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু সুস্থ রাজনীতির অন্তর্গত নয়। ২০১৫ সালে যে হিউম্যান ক্যাপিটাল রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কিন্তু আমাদের বক্তব্যেরই প্রতিফলন ঘটেছে। রিপোর্ট অনুসারে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪টি দেশের মধ্যে ৯৯তম। ভুটানের পরই বাংলাদেশের স্থান। নিম্ন আয়ের দেশের মধ্যে কম্বোডিয়া ও তাজিকিস্তানের পর বাংলাদেশের অবস্থান।
রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের ৮২ ভাগ মানুষ যারা কাজ করেন তাদের বয়স ২৪ থেকে ৫৪-এর মধ্যে। এদের মধ্যে মাত্র ৬.৩ ভাগ উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন। কর্মক্ষম ১০ কোটি ৬১ লাখ হলেও কর্মের সঙ্গে যুক্ত ৭১ শতাংশ। বাংলাদেশে যে বিজনেস স্কুল সমূহের রমরমা তার মান মাঝারি ধরনের, স্কোর ৭-এর মধ্যে ৩.৭২। এদেশে প্রকৌশল, উৎপাদন ও নির্মাণক্ষেত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন মাত্র ১৪ হাজার ও স্বাস্থ্যসেবায় ৫ হাজার। অন্যান্য বিষয়ে কয়েক লাখ। বাংলাদেশ সান্ত্বনা পেতে পারে এ ভেবে যে, পাকিস্তানের স্থান ১১৩ তম। [বণিক বার্তা, ১৫.৫.১৪]
যে জনসংখ্যা আমরা রফতানি করি তার অধিকাংশই নিচুমানের কাজে জড়িত। এগুলো দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে না। প্রায় ১০-১১ রকমের শিক্ষাব্যবস্থা থাকলে এ পরিস্থিতিরই সৃষ্টি হতে পারে। মাদ্রাসা শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ দেশের জন্য শুভ নয়, লাভজনকও নয়। এসব কিছু মনোজগতে হেজাবি আধিপত্য সৃষ্টিতে সহায়তা করে। যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাসের স্থান নেই, নিজের দেশের মানুষের আত্মদানের ইতিহাস অনুপস্থিত, সেদেশে প্রজন্ম শেকড়হীন। টিউলিপ জয় পেয়েছে তার রাজনীতির শেকড়ের জন্য। কিন্তু যে প্রজন্ম শেখ হাসিনরা রেখে যাচ্ছেন তারা তো শেকড়হীন। তাহলে তার লিগ্যাসি বা সাফল্য লালন করবে কে? এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা দরকার। উন্নয়নের সঙ্গে যখন সংস্কৃতি এগোয় তখন একরকম মানুষ জন্মে, সে পরিবেশে বড় হয়। কম উন্নয়ন ও বিমা সংস্কৃতিতে তারেক রহমানদের শুধু জন্ম নয়, পরিবৃদ্ধি হয়। উন্নয়ন হবে, সঙ্গে হেজাবির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে তা কাম্য নয়। শেখ হাসিনা দলে অনেকে বিশ্বাস করতে পারেন, হেজাবিদের তোয়াজ করলে তারা ভোটের বাক্স ভরে দেব। মাওলানা শফী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের তো সরকার অনেক দিয়েছে বলে শুনেছি, কিন্তু তারা কি সরকারের ভোটের বাক্স ভরেছে না তাকে সমর্থন করছে? যে বিএনপি-জামায়াত করে সে নৌকায় ভোট দেবে এ থিসিস যারা দেয় তারা মতলবি, হেজাবিদেরই ফ্রন্ট হিসেবে কথা বলে। সুযোগ-সুবিধা তাদের সাময়িকভাবে চুপ করাতে পারে সব সময় না। একথাটা মনে রাখা উচিত আওয়ামী নেতাদের, যারা খবরের কাগজও পড়েন কিনা সন্দেহ হয়। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান ভেঙে ছিল, পাকিস্তানি বাঙালিরা একথা ভুলতে পারবে? আর হেজাবিদের সবসময়ই তুষ্ট রাখতে হবে আর যারা শেখ হাসিনা জন্য করবেন বা মরবেন তাদের উপক্ষো করতে হবে- এটি বিকৃত মনোভঙ্গি। উন্নয়ন বিপ্লব হচ্ছে, তার সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিপ্লব না হোক সংস্কারের কাজটি শুরু করতে হবে।
এখন আমরা কোথায়? : যখন স্বাধীন হই তখন আমাদের গড় আয়ু ছিল ৩৬। এখন গড় আয়ু ৭২। যখন স্বাধীন হই তখন মাথাপিছু আয় ছিল কয়েকশ ডলার। এখন তা দু’হাজার ছুঁইছুই। প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা খুব সম্ভব ৯৩ ভাগ। শিশুদের টাকা দেওয়া হচ্ছে ১০০ ভাগ। প্রসূতি মৃত্যু দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে বাংলাদেশে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নারীদের অর্থনৈতিক অর্জনে বাংলাদেশ প্রথম।
বস্ত্র রফতানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগ মাংস উৎপাদনের পঞ্চম, চামড়া উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে সপ্তম, আরো আছে। ১৯৭১ সালে দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না, এখন জমির পরিমাণ ১৯৭১ সাল থেকে কমপক্ষে ২০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে কিন্তু খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণ। গ্রামে নগরায়নের ছোয়া লেগেছে। প্রত্যেকটি এলাকা একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত। গাড়ির ভিড়ে ঢাকায় হাঁটা যায় না।
পদ্মা সেতু হয়ে গেল। মেট্রোরেল হচ্ছে। পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর হচ্ছে। পরমাণু শক্তির প্রথম পর্বের কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা চট্টগ্রাম, ঢাকা ময়মনসিংহ চারলেন সড়ক হয়েছে। মধ্যবিত্ত এবং বিত্তশালীর পরিধি বেড়েছে। দারিদ্র হ্রাস পেয়েছে বিস্ময়কর ভাবে। উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। হাসিনা আমলে উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে গেলে একটি বই লিখতে হবে।
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিছু কাজ শুরুও করেছিলেন। ঘাতকদের কারণে কাজ শেষ করতে পারেননি। তিনি সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন।
তাঁর কন্যা জল স্থল ও অন্তরীক্ষ জয় করেছেন। তিনি বাংলাদেশের স্থল ও জলসীমা চিরদিনের জন্য নির্ধারণ করেছেন। ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বলব, গত দশ বছরে শেখ হাসিনা যা করেছেন, বাংলাদেশকে অনুন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তর করেছেন, গত কয়েকশ বছরে আর কোন নেতা তা করতে পারেননি।
আরেকটি সুখবর। কয়েকদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ভারতীয় পার্লামেন্টে বলেছেন, বাংলাদেশে গত এক দশকে হিন্দুদের সংখ্যা ৮ ভাগ থেকে ১০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল। এর অর্থ শেখ হাসিনার আমলে সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশে নিরাপদ।
কেন শেখ হাসিনাকে আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই? : শেখ হাসিনার আমলে ঘাতকদের বিচার হয়েছে। দু’ধরনের ঘাতকদের। ১৯৭১ সালের এবং ১৯৭৫ সালের। জেনারেল জিয়া-খালেদা জিয়া-নিজামী-মোজাহিদ-এরশাদ প্রমুখ যে পাকিস্তানের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, হাসিনা সেটি প্রতিরোধ করেছেন এবং পাকিমনাদের জমিন সংকুচিত করছেন।
খালেদা জিয়াও নিজামী সৃষ্ট জঙ্গিদের কঠোর হস্তে দখল করেছেন। অসাম্প্রদায়িকতা বিকশিত হচ্ছে। সমহারে না হলেও সব শ্রেনির উন্নয়ন হচ্ছে। রাষ্ট্রের উন্নয়ন হচ্ছে এবং তা দৃশ্যমান।
শেখ হাসিনার বিভিন্ন কার্যক্রমের আমরা সমালোচনা করতে পারি, তার অনেক কার্যক্রম আমাদের মনঃপূত নাও হতে পারে, কিন্তু তিনি ফিরে এসে যা করেছেন তাতে ইতিবাচক দিকের সংখ্যাই বেশি। তাঁর পিতা আজন্ম সামরিক বা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনিও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন এবং সৈন্যরা যাতে উচ্চাকাক্সক্ষী না হয় সে কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছেন যার একটি ধারায় আছে যিনি বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করবেন, তিনি ক্ষমতাচ্যুত যখন হবেন [হতে হবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যই তা’] তখন তাকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাস দমনের কারণে আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপের দরুন বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও নারী উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ অনেকটা রোলমডেলের অভিধা পেয়েছে। বাংলাদেশকে এখন উপেক্ষা করা যায় না। তিনি দেশের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছেন। বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংরক্ষণ করেছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব ফিরিয়ে আনছেন। তিনি সাধারণ মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে এনেছেন। বাংলাদেশের এখন বিদেশি সাহায্য না পেলেও চলবে, মুখ থুবড়ে পড়বে না। আলু থেকে জাহাজ সবকিছুই রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। এখন বাংলাদেশে মঙ্গা নেই। দারিদ্র্যের হার কমছে। দারিদ্র্য আছে, কিন্তু ক্ষুধার্ত হয়ে বাংলাদেশে আর কারো মৃত্যু হবে কিনা সন্দেহ। এজন্য তাকে নিত্য লড়াই করতে হয়েছে এবং হচ্ছে পাকিস্তানি বাঙালি, রাজনৈতিক দুর্বত্ত ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন জিয়াউর রহমান। সেই ক্ষতি ও সেই ক্ষত থেকে বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা ফিরিয়ে এনেছেন। সামরিক শাসক ও বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। তিনি এখন বাংলাদেশেকে সবল রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আমি যা বর্ণনা করলাম তাহলো একটি সংক্ষিপ্তসার মাত্র। ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের আর কোনো রাজনীতিবিদ বা সরকার প্রধানের এত অর্জন বা সাফল্য নেই। এত সাফল্যও অর্জন যেন তাকে অভিভূত বা আছন্ন না করে ফেলে, তাই কামনা করি। তার নিত্য ভাবনা যেন হয় তিনি কিছুই করেননি। তার আরও অনেক করার আছে- তাই নিত্যলড়াই করে যেতে হবে তাকে এই কামনাই করি।
আগেও বলেছি, আবারও বলছি- তার অনেক সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হলেও আমরা বাঙালিত্ব দর্শনে বিশ্বাসী এবং সেকারণে তার নেতৃত্বে আস্থাশীল। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার তিনি করছেন, একারণেও তার প্রতি আমরা যারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছি তারা কৃতজ্ঞ। যারা বিশ্বাসী নয়, বিশেষ করে গত প্রজন্ম, তাদের যতই এবিষয়ে জ্ঞানদান করা হোক না কেন তাদের আর বিশ্বাসী করা যাবে না। তাদের প্রতিনিধি এক বুড়োভাম নয়া দিগন্তে লিখেছেন, শেখ হাসিনার পরিণতি হবে শেখ মুজিবের মতো। এই যে মনোভঙ্গি- এটাই পাকিস্তানি বাঙালির মনোভঙ্গি। এটিই নষ্টদের চরিত্র তুলে ধরে। নষ্টদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন শেখ হাসিনা ১৯৮১ সাল থেকে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন, আরও পথ পেরুতে হবে। তার এই যাত্রায় আমরা আছি তার সঙ্গে। নষ্টদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে, পাকিস্তানি বাঙালিদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে, তারা উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে।
আজ বাঙালিদের সরকার আসার পর এই রাষ্ট্রকে সবাই সমীহ করছে। মানবতা বিষয়ক অপরাধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচার করায় এই কথাই প্রমাণিত হলো- যে এ রাষ্ট্র এখন দায়হীনতা বিশ্বাস করে না। যে রাষ্ট্র পরিচিত ছিল শূন্য ঝুড়ি হিসেবে সে রাষ্ট্র আজ চাল রফতানী করছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ যদিও একই ভূখন্ডে জনগণ দ্বিগুণ হয়েছে। জঙ্গি মৌলবাদ দমনে নিরন্তর হওয়ায় এখন আর মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত নয়।
সামনে নির্বাচন। এখন প্রশ্ন কয়েকটি-
১. আপনি কি উন্নয়ন চান? নিজের অবস্থা উন্নীত করতে চান?
২. আপনি কি মৌলবাদী রাষ্ট্রের নাগরিক হতে ভালোবাসেন?
৩. আপনি কি পরিবারের নিরাপত্তা ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চান।
৪. সংখ্যালঘুরা কি গয়েশ্বর হতে চান। গয়েশ্বররা ক্ষমতায় গিয়ে আপনাদের দেশ ছাড়া করেছিল, ন্যাংটো করে সীমান্ত পেরুতে বাধ্য করেছিল। মহিলাদের ধর্ষণ করেছিল।
৫. গত দু’দশকে বিএনপি-জামায়াত শাসনের মাজেজা মনে আছে কিনা। মনে নেই যে এক বিধবা মা বলছেন যুব দলের নেতাদের যে, বাবা, তোমরা একজন একজন করে আসো, আমার মেয়েটা খুব ছোট। মফস্বলে এক বিধবার কিশোরী কন্যাকে ধর্ষণের জন্য জড়ো হয়েছিল খালেদার ‘সোনার ছেলেরা’। কীভাবে হত্যা করেছিল পুলিশ, সাধারণ মানুষ। আগুনে আগুনে ছাড়খার করে দিয়েছিল দেশ। ৫০০ স্কুল পুড়িয়ে দিয়েছিল। মনে পড়ে?
৬. ভাবতে পারেন আওয়ামী লীগ অনেক কিছু ঠিকঠাক মতো করছে না, তা বলে কি পাকিস্তানিদের ভোট দিতে হবে? এটুকু শুধু বলে রাখি। বিএনপি-জামায়াত এবার ক্ষমতায় এলে প্রশাসন [সামরিক বেসামরিক যাই হোক]। আদালত থেকে গ্রামের পর্ন কুটিরের সামান্যতম মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক কোন পরিবার রক্ষা পাবে না। একেবারের জন্য তারা পাকিস্তান ভাণ্ডার প্রতি শোধ নেবে। তাই সামগ্রিকভাবে চিন্তা করা বাঞ্ছনীয়।
কয়েকদিন আগে আমি খুলনা থেকে যশোরে আসছিলাম। চালক মুসল্লি, দেখে মনে হয়। নানা কথার ফাঁকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, শেখ হাসিনা এত কিছু করছেন তারপরও এখানকার মানুষ এতে বিরোধিতা করে কেন? তিনি উত্তর দিলেন না। আবার অন্যান্য কথার ফাঁকে ঐ প্রশ্নটা করলাম। মিনিট খানেক চুপ থেকে বললেন, শেখ হাসিনা এদেশের জন্য যা করেছেন তা আর কেউ করেনি। আপনি যদি সাফ মনের মানুষ হন, ঈমান থাকে তা’হলে আপনি শেখ হাসিনাকেই ভোট দেবেন।
আমরাও বলি, যদি ভালো মানুষ হন, উন্নয়ন চান নিজের পরিবারের দেশের, যদি ধর্ম মানেন অর্থাৎ ঈমানে ঠিক থাকেন তা’হলে অবশ্যই শেখ হাসিনা আপনার ভোট পাবেন।
বাঙালির সামনে অফুরন্ত সম্ভাবনা। যদি এ রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী, অপরাধী ও তাদের সমর্থকদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধ করে ক্ষমতা দখল করতে না দেয়, তা’হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম বা বর্তমান প্রজন্ম সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে নির্বিবাদে ঘুরে বেড়াতে পারবে। আমাদের জেনারেশনও এখন পরিবর্তনের আভাস অনুধাবন করতে পারছে। এখন আর বিদেশে সবুজ পাসপোর্ট দেখালে ভ্রু কোঁচকায় না বা অজ্ঞ ইমিগ্রেশন অফিসার জিজ্ঞেস করে না বাংলাদেশ কোথায়?
স্বাধীনতা অর্জনের দিনটি বিজয় দিবস হিসেবে কোনো রাষ্ট্রই ঘোষণা করেনি। বাঙালি করছে। প্রতি বিজয় দিবসে তরুণদের এই কথাই ভাবতে হবে, আমরা বিজয়ী থাকব এবং এই বিজয়ী থাকতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অক্ষুণœ রাখা ছাড়া বিকল্প নেই এবং সেই ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্ব তরুণদের, আমাদের।
শেষ কথা : সামনে নির্বাচন। দেশের ভবিষ্যত কী হবে তা নির্ধারণ করবে, এ নির্বাচন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলব- সব বিকল্পের বিকল্প আছে, এখন শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই।
Add Comment