গত শতকের পঞ্চাশ দশকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়িত করার প্রথম সক্রিয় প্রচেষ্টা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ছিল সে পদক্ষেপ। এ কারণেই ৬ দফাকে বাঙালির মুক্তিসনদ বলা হয়।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে লাহোরে বিরোধীদের এক সভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রস্তাব করেন। ৬ দফার কথা তাঁর দলেরও কেউ জানতেন না। ৬ দফা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিতর্ক শুরু হয়। বিরোধীদের বৈঠক ভেস্তে যায়। ঢাকায় ফিরে নিজ দল আওয়ামী লীগেও তিনি বিরোধিতার সম্মুখীন হন। ৬ দফা তিনি বাঙালির দরবারে হাজির করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ বিরোধী দলও ৬ দফার বিরোধিতা করে। কিন্তু সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে ৬ দফা। আন্দোলনে পরিণত হয় তা। এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয়েছে বইমেলায় প্রকাশিত আমার গ্রন্থ ৬ দফা : স্বাধীনতার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু গ্রন্থটিতে [মাওলা ব্রাদার্স, ২০২০]
৬ দফা নিয়ে আমরা নিত্য আলোচনা করি বটে কিন্তু ৬ দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা কখনো হয়নি। বিদেশিরা কী ভাবছিলেন ৬ দফা নিয়ে তা’তো নয়। ঢাকায় তখন প্রধান দুই দেশ আমেরিকা ও গ্রেট ব্রিটেনের কনস্যুলেট ছিল। তারা নিয়ত খোঁজ রাখত ৬ দফার। তাদের বিভিন্ন রিপোর্টের ভিত্তিতেই প্রবন্ধটি রচিত।
৬ দফা নিয়ে ভারত, ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্র কী ভাবছিল? ব্রিটিশ ও মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের দলিলপত্র সব মুক্ত করা হয়েছে এবং সেগুলো গ্রন্থিতও হয়েছে। এসব রিপোর্টে দূতাবাস কর্মকর্তারা তাদের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছেন সদরে। তবে, এসব প্রতিবেদনে শেখ মুজিব ছাড়া অন্যরা কী ভাবছেন সেটিও বলা হয়েছে। ঐসব পর্যালোচনা করলে ৬ দফা সংশ্লিষ্ট সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে ১৯৬৬ সালের ১৩ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয় লন্ডনে। প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব চাচ্ছিলেন বিরোধীদেরও সরকারে নিয়ে আসার। তিনি নুরুল আমীনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নুরুল আমীন দুটি শর্ত দিয়েছিলেন- ১. পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন ফান্ড বাড়াতে হবে যাতে এর স্বয়ম্ভরতা বৃদ্ধি পায় এবং পাট থেকে যা আয় হয় তা ন্যায্যভাবে দুই প্রদেশে বণ্টন করতে হবে। ২. ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৯৭০ সালের মধ্যে ভোট দেয়ার অধিকার দিতে হবে। ৩. ভবিষ্যতে সার্বজনীন ভোটাধিকার দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু
এসব খবর কেউ জানতেন না। কিন্তু ঢাকার আওয়াজ পত্রিকা তা ফাঁস করে দেয়। এতে নুরুল আমীন ও সরকার বিব্রত হন। ব্রিটিশ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিষয়টি কার্যকর হলে ভালো হয়। কারণ, ‘He is wise and honest old man would support a non-aligned policy but push for a genuinely non-aligned one. He would be generally sympathetic to western intersts and voice of reason on the vital issues involving relations with India.’
প্রতিবেদনে শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের অগ্নিময় সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নুরুল আমীন ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন পাকিস্তানের, ১৯৭১ সালের পর। তিনি আর বাংলাদেশে ফিরতে পারেননি।
৬ দফা ঘোষিত হওয়ার পর মার্চে ব্রিটিশ হাইকমিশন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে ভাবনা বুঝতে চাচ্ছিল। এর কারণ বোধহয় তাসখন্দ চুক্তি, ৬ দফা ও আইয়ুবের বিবৃতি সম্পর্কে পূর্বাঞ্চলের নেতারা কী ভাবছেন সে সম্পর্কে কূটনীতিবিদরা একটি ধারণা পেতে চাচ্ছিলেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ৭ থেকে ২১ মার্চ অব্দি ঢাকায় ছিলেন। সে সময় ৬ দফা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, যারা স্বায়ত্তশাসন ও স্বয়ম্ভরতার সমর্থক তারা বৃহৎ বঙ্গেরও সমর্থক। ব্রিটিশ হাইকমিশন জানাচ্ছে, এ ধারণা ভ্রান্ত কারণ তারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। নুরুল আমীন, ফরিদ আহমদ, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং শেখ মুজিবুর রহমানও একবাক্যে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের কেউ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে চান না। কেন যুক্ত হবে? এ প্রশ্ন তুলেছেন সবাই। এতে লাভ কী এবং রাজনৈতিকভাবে তা যে অসম্ভব এটিও তারা জানেন। বিরোধী নেতা এ মুহূর্তে পাকিস্তানে একটি ন্যায্য হিস্যা চান। হাইকমিশনের এক পার্টিতে শেখ মুজিব জানান, ৬ দফা দাবিতে তিনি অনড় থাকবেন জেলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। পরবর্তীকালে ৬ দফার জনসভাগুলোতে দেখি বঙ্গবন্ধু যুক্ত বাংলার ধারণা নাকচ করছেন এবং আমৃত্যু ৬ দফা দাবিতে অনড় থাকার কথা বলছেন।
রাওয়ালপিন্ডি থেকে ২৮ এপ্রিলের প্রতিবেদনে ৬ দফা ও মুজিব সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠানো হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ন্যাপ ৬ দফাকে সমর্থন করছে ভালোভাবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বিরোধীরা বেশি সাড়া পাচ্ছে যা প্রেসিডেন্টের জন্য বিপজ্জনক। ৬ দফা দাবি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। অন্যদিকে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খান এর বিরুদ্ধে অযৌক্তিক সব বক্তব্য রাখছেন। মনে হচ্ছে, সরকার মুজিবের প্রতি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। তাঁকে গ্রেপ্তার, জামিন, গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের বিচার বিভাগ অনেকটা স্বাধীন। সুতরাং মুজিবকে সরকার কতদিন জেলে আটকে রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। হতে পারে, এখানেও পশ্চিম পাকিস্তানের মতো ব্যাপকহারে ধরপাকড় শুরু হতে পারে।
মার্কিন দূতাবাস ফেব্রুয়ারি মার্চে ঢাকা থেকে যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে তাতে ৬ দফা ও শেখ মুজিবের প্রসঙ্গই এসেছে।
১৯৬৫ সালের ২৯ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় অভিযুক্ত করে ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার এক বছরের কারাদণ্ড দেন। মামলার অভিযোগ ছিল ১৯৬৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে ঢাকা স্টেডিয়ামে শোকসভার আয়োজন করা হয়েছিল। মুজিব বক্তৃতায় সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর জন্য সরকারকে দায়ী করেছিলেন। হাইকোর্ট মুজিবকে সাময়িক জামিন দেয়।
প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, মুজিব নিজেও বোধহয় তা চাচ্ছিলেন। তাহলে, ফোকাস ন্যস্ত হয়ে আওয়ামী লীগ ও তাঁর ওপর। তিনি পরিচিত হবেন নির্যাতিত রাজনৈতিক নেতা হিসেবে।
৬ দফার কারণে মুজিব অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের প্রবক্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং এখন তিনি রাজনৈতিক পাদপ্রদীপের আলোয়। লাহোর থেকে ফেরার পর এ অঞ্চলে তাঁর সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে। ৬ দফা নিয়ে চতুর্দিকে আলোচনা চলছে। এমনকি সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলোও তাঁকে ভালো জায়গা দিচ্ছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছে এবং অশান্তিতে আছে। মুজিব এই ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবেন কিনা এখন তাই দেখার বিষয়।
ছয় দফা শীর্ষক পুস্তিকার প্রচ্ছদ
এপ্রিলের ৬ তারিখে এক পার্টিতে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার এ কে রায়ের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা ফ্রানসিস প্রেসকটের সঙ্গে আলাপ হয়। আলাপের বিষয় ছিল ৬ দফা নিয়ে আইয়ুবের উক্তি ও তার প্রতিক্রিয়া।
রায়ের মতে, ৬ দফার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় আইয়ুব গভর্নরের পরামর্শ শোনেননি। আইয়ুবকে প্ররোচনা দিয়েছে বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী। বর্তমান অবস্থায় তারা আশঙ্কায় ভুগছে। আদমজীর বাসায় মার্চের ১৬ তারিখে তাদের বৈঠকে, আইয়ুবকে তারা পরামর্শ দেন কঠোরভাবে হুমকি দেয়ার জন্য। তারা আইয়ুবকে নিশ্চিত করেন এ বলে যে, বাঙালিরা কাপুরুষ এবং ভায়োলেন্স ভীত। কোথাও ঝামেলা দেখলে প্রথম সুযোগেই তারা পালাবে। সুতরাং মুজিবের প্রভাব থেকে তাদের দূরে রাখতে হুমকি-ধমকি দেয়াই শ্রেয়। বাঙালিদের প্রতি আইয়ুবের ধারণাও তাই। সুতরাং এ পরামর্শ তিনি গ্রহণ করেন। সে কারণে, ঢাকায় অবস্থানকালে যুক্তবঙ্গ, স্বাধীন বাংলা, গৃহযুদ্ধ বিষয়ে বক্তব্য দেন।
রায়ের মতে, আইয়ুব হয়তো তার গোয়েন্দা সংস্থা মারফত খবর পেয়েছেন, তার এসব বক্তব্য আগুনে ঘি ঢেলেছে। সে কারণে, এখন সরকার খানিকটা নমনীয় ভাব দেখাচ্ছে, এমনকি গভর্নরও। সবুর খান ঢাকায় বলছেন ‘গৃহযুদ্ধ’ সম্পর্কে আইয়ুবের বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
এ প্রতিবেদনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মানস জগৎ সম্পর্কে একটি ধারণা পাই। ১৯৭১ সালেও ইয়াহিয়া খান ও তাঁর নীতিনির্ধারকরা মুজিবের বিরুদ্ধে সেই একই কৌশল অবলম্বন করে পাকিস্তানের ধ্বংস ডেকে এনেছিলেন।
২৬ এপ্রিল ঢাকার মার্কিন উপদূতাবাস শুধু ৬ দফা ও শেখ মুজিবের ওপর একটি প্রতিবেদনে তৈরি করে তা প্রেরণ করে সদরে।
প্রতিবেদনে বলা হয় মুজিবের কৌশল খুব সরল- ১. মূল বিষয় ৬ দফা এবং সব বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বারবার বলা, ২. ঢাকার বাইরের অঞ্চলে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া, ৩. সরকারকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে রাখা, ৪. প্রতিরোধ সহিংস ও আইনের পথে করা হবে প্রয়োজনে গ্রেপ্তার বরণ করা, ৫. অন্য কোনো বিষয়ে মনোসংযোগ না করা যেমন বিদেশ নীতি।
৬ দফা পেশের সময়টাও ছিল উপযোগী। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান ছিল অরক্ষিত এ ধারণাটা মানুষের মনে সজীব, অর্থনৈতিক কষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে, ভারতের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছে। আওয়ামী লীগে মুজিবের অবস্থান এখন দৃঢ় ও সংহত।
কনস্যুলেট যেসব খবর পাচ্ছে তাতে জানা যাচ্ছে, মুজিবের জনসভায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে লোক আসছে। খুলনা খান এ সবুরের ঘাঁটি কিন্তু সেখানেও তাঁর থেকে মুজিব জনপ্রিয়। এপ্রিল ২৪ এ ঢাকায় বৃহৎ জনসভা হয়েছে অথচ মুজিব ছিলেন সেখানে অনুপস্থিত।
তিনি শিক্ষক, ছাত্র, সরকারি কর্মচারী এবং মধ্যশ্রেণিকে আকর্ষণ করছেন। মুজিব এখনো কৃষকদের কাছে পৌঁছাননি, কৃষকরাও রাজনীতি থেকে দূরে এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে তারা এখনো ওজনদার কোনো শক্তি নয়। মুজিব মনে হয় ভাবছেন, এ শক্তির কথা পরে ভাবা যাবে। তিনি মনোযোগ দিচ্ছেন আয়তনে ছোট মধ্যশ্রেণির ওপর কারণ, তাঁর ধারণা এরাই রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার শক্তি। এরাই এখন ক্ষুব্ধ কারণ তাদের ধারণা পূর্ব পাকিস্তান শোষিত হচ্ছে।
সরকার পক্ষ এখন বিব্রত। মুসলিম লীগের একাংশও এখন ৬ দফার প্রতি সহানুভূতিশীল। ফজলুল কাদের চৌধুরীও এখন স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। বিরোধী অন্যান্য দলও যোগ দিতে পারে আওয়ামী লীগের সঙ্গে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুজিব উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং আগ্রাসী এজিটেটর এবং বক্তা হিসেবে কেউ তার তুল্য নয়। তিনি সচেতন এখন তার জনসমর্থনে তাই অন্যান্য দলের সহায়তার প্রয়োজন বোধ করছেন না। হঠাৎ করেই তিনি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রধান প্রবক্তা হয়ে উঠেছেন এবং ‘has no intention of sharing spotlight.’ অধিকাংশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এখন মনে করেন বিরোধী অন্যান্য নেতার থেকে মুজিব এখন অনেক এগিয়ে এবং আওয়ামী লীগের জনসমর্থন দ্রুত বাড়ছে।
ঢাকা থেকে ২৯ এপ্রিল আরেকটি ইন্টারেস্টিং প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল। ঐ দিন, লে. হোসেন দূতাবাসে এসে ভারপ্রাপ্ত কনসাল প্রেসকটের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। প্রেসকট দেখা করলেন। হোসেন জানালেন, করাচির নৌ অ্যাটাচির অফিসের লে. নোবল তাঁকে প্রেসকটের নাম দিয়েছেন। প্রেসকট আগে তাঁকে কখনো দেখেননি। তবে, হোসেন জানালেন, নোবলের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে তাঁর যোগাযোগ আছে। করাচিতে নৌ দপ্তরে হোসেন ৫ বছর ধরে আছেন। তিনি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁর বয়স ৩০ এর কাছাকাছি। তাঁকে এখন করাচি থেকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়েছে। তাঁর বাড়ি বরিশাল যেখানে তিনি এখন ‘হোম লিভ’ ভোগ করছেন। হোসেন জানালেন, নোবল তাঁকে জানিয়েছেন দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসকটের সঙ্গে আলোচনার জন্য।
লে. হোসেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ উদগীরণ করলেন। এখন যে আন্দোলন চলছে তা ‘সেপারেটিস্ট আন্দোলনে’ পরিণত হবে দ্রুত। এ ধরনের ঘটনা ঘটবে এটি তার ধারণায় ছিল কিন্তু এত দ্রুত পরিবর্তন আসবে তা ভাবেননি। বরিশাল গিয়ে তার মনে হয়েছে, এই আন্দোলন এখন তৃণমূলে পৌঁছেছে। পূর্ব পাকিস্তানকে এখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করার কথা ভাবছে তৃণমূল পর্যায়ে। মুজিবের উত্থানে হোসেন বিস্মিত এবং তাঁর মতে, মুজিবের সমকক্ষ এখন আর কেউ নয়।
মুজিব সাফল্য পাওয়া সত্ত্বেও হোসেনের মতে, আওয়ামী লীগ দুর্বল। একটা সময় আসবে যখন সরকার কঠোরভাবে এ আন্দোলন দমন করতে চাইবে কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। আন্দোলন চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। পুলিশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা ‘will be isolated and besieged if not exterminated.’
বিহারি ও ধনী পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে।
৬ দফা স্বাধীনতার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু, মুনতাসীর মামুন, মাওলা ব্রাদার্স
সুতরাং অবস্থা সংকটাপন্ন। এ সময় যে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দেবে তা পূরণ করবে সংগঠিত ন্যাপ বা পিকিংপন্থি। মওলানা ভাসানীর এখানে কোনো ভ‚মিকা থাকবে না কারণ সাম্প্রতিককালে সরকারের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম তাঁকে নিন্দিত করে তুলেছে। মোটকথা কম্যুনিস্টদের হাতে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন চলে যাবে।
লে. হোসেনের মতে, জনগণকে এ পর্যন্ত অর্থাৎ স্বায়ত্তশাসন/স্বাধীনতার আন্দোলন সংগঠনে শেখ মুজিব অনন্য। নিম্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগাররা মুজিবের অনুগত সমর্থক এবং তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, মুজিবের স্থলাভিষিক্ত হবেন। এটিই আওয়ামী লীগের দুর্বলতা। অন্যদিকে ন্যাপ অনেক বেশি সংঘটিত।
লে. হোসেন জানালেন, গত কয়েক সপ্তাহ তিনি মুজিব ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। এবং এখন তাঁর ধারণা দৃঢ় হয়েছে যে, মুজিব বা আওয়ামী নেতারা দলের দুর্বলতা নিয়ে অবগত নয়। অন্যদিকে লে. হোসেন প্রতিনিধিত্ব করছেন ভালোভাবে সংগঠিত ও যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে পরিচালিত একটি গ্রুপকে। তাদের মূল উদ্দেশ্য, স্বায়ত্তশাসন/স্বাধীনতার আন্দোলন যাতে কমিউনিস্ট নেতৃত্বে না যায় তা ঠেকানো। তাঁর গ্রুপ বড় কিছু নয়, কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত সামরিক, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, যোগাযোগ ও পুলিশ, বেতার এবং প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা। এই গ্রুপ কীভাবে সরকারের দখল নিতে হবে তা জানে এবং সংকটাপন্ন সময়ে তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবে এবং যদি তারা তা করে তা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে কিনা? কেননা তা কমিউনিজম ঠেকাবে যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূল।
প্রেসকট এক কথায় তা নাকচ করে দিলেন। হোসেন জানালেন, এই উত্তর তিনি আশা করছিলেন। তবে, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা অন্যান্য কোনো দেশ বা প্রদেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সেজন্য তাঁর মনে হয়েছিল, প্রেসকট তার সমব্যথী। তাঁর গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রের নৈতিক সমর্থন পেলে তারা দ্রুত তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারত। ভারতের বিষয়টি হোসেন বাদ দিলেন কারণ ভারতের সমর্থন নিলে ফল ভালোর চাইতে খারাপ হবে।
প্রেসকটের মতে, হোসেন কমিউনিস্ট বিরোধী সবদিক থেকে। তবে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছা সম্পর্কে সে খুবই আত্মবিশ্বাসী। উপসংহারে প্রেসকট লিখেছেন, হোনে একজন সেপারিটিস্ট না কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট জেনারেলকে ফাঁদে ফেলতে এসেছেন তা অবশ্য জানার উপায় নেই।
এই লে. হোসেন ধরে নিতে পারি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন যিনি আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন এবং যাকে পরে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে।
আগরতলা মামলা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় কখনই কোনো মন্তব্য করেননি। সুতরাং মূল বিষয় সম্পর্কে কখনই আর জানা যাবে না। তবে, এ সম্পর্কে অনেকের ভাষ্যই আছে। আমি দুটি ভাষ্য তুলে ধরছি।
১৯৭২ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তিনি লিখেছেন, ‘সেদিন আমাদের বিশ্বাস করে আরো একটি কথা বললেন শেখ সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে বলিয়ে নেন যে আমরা প্রকাশ করব না। আমি এমন কথার খেলাপ করছি ইতিহাসের অনুরোধে। আমি প্রকাশ না করলে কেউ কোনো দিন করবে না।
আমার কী প্ল্যান ছিল, জানেন? অকস্মাৎ আমরা একদিন পাওয়ার সিজ করব। ঢাকা শহরের সব ক’টা ঘাঁটি দখল করে নেব। আর্মিতে, নেভিতে, এয়ারফোর্সে, পুলিশে, সিভিল সার্ভিসে আমাদের লোক ছিল। কিন্তু একটা লোকের বিশ^াসঘাতকতার জন্য সব পণ্ড হয়। নেভির একজন অফিসার বিশ্বাস করে তার অধীনস্থ একজনকে জানিয়েছিলেন। সে ফাঁস করে দেয়। তখন আমরা সবাই ধরা পড়ে যাই।’
তিনি আক্ষেপ করেন।
আমি প্রশ্ন করি, ‘ঘটনাটা ঘটত কোন তারিখে?’
তিনি মৃদু হেসে উত্তর দেন, ‘বলব না।’
এ বিষয়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীরও একটি ভাষ্য আছে। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ছিল। ৬ দফা ঘোষণার আগে মোয়াজ্জেমের সঙ্গে গাফ্ফার চৌধুরীর আলাপ হয়। তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন, ‘আপনাকে আজ রাত্রেই শেখ সাহেবের ধানমন্ডির বাসায় যেতে হবে। তাঁকে আমাদের হয়ে বলতে হবে, তিনি যেন লাহোর বৈঠকে তাঁর প্রস্তাব ও দাবি না জানান। তাতে আইয়ুব সরকার সতর্ক ও সাবধান হয়ে যাবে। শেখ সাহেব দয়া করে কিছুদিন চুপ থাকুন। আমাদের এদিকের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। আর্মস-এর চালান হাতে এসে পৌঁছলেই আমরা বিদ্রোহ করব এবং ক্যান্টনমেন্ট, আর্মস ডিপো, বেতার, টিভি ও এয়ারপোর্ট দখল করে নেব। এর আগে শেখ মুজিব কোনো আন্দোলন শুরু করলে আইয়ুব সতর্ক হয়ে যাবেন এবং আমাদের সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যাবে। আমি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যদি অস্ত্রবলে সারা পূর্ব পাকিস্তান মুক্ত করতে পারেন, তাহলে শেখ মুজিব বা তাঁর মতো রাজনীতিকদের হাতে দেশ শাসন করার ভার আপনারা ছেড়ে দেবেন কি?’
মোয়াজ্জেম একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘একটা সরকার চালাতে রাজনীতিকদের সাহায্য অপরিহার্য। আমরা অবশ্যই শেখ সাহেবদের সাহায্য ও সহযোগিতা নেব।’
আমার বুঝতে বাকি রইল না, কমান্ডার মোয়াজ্জেম কী বলতে চাইছেন।
যা হোক, গাফ্ফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। দুপুরের খাবার খেতে খেতে তারা আলাপ করছেন। লিখেছেন তিনি, ‘আমি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেমের নামটা উচ্চারণ করতেই শেখ সাহেব বললেন, আমি তাঁকে জানি। তাঁর প্রস্তাব কী তাও আমি জানি। মানিক চৌধুরীর সঙ্গেও মোয়াজ্জেম আজকাল মেলামেশা শুরু করছে।’
মানিক চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একজন নেতা। পরবর্তীকালে আগরতলা মামলার আসামি। বঙ্গবন্ধু গাফ্ফার চৌধুরীকে আরো বললেন, ‘আমি মানিককেও বলে দিয়েছি, এসব পাগলামিতে না জড়াতে। তোমাকেও বলছি, এসব কাজে জড়িও না। আমাদের সংগ্রাম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম। সামরিক অভ্যুত্থান বা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমি জড়াতে চাই না। পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আমি লড়াই করছি। পাকিস্তান সামরিক জান্তার বদলে বাঙালি সামরিক জান্তাকে ক্ষমতায় বসাতে আমি আন্দোলন করছি না।’
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিবরণ বিভ্রান্তিকর। ৬ দফা কবে কোথায় ঘোষণা করবেন বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউ তা জানতেন না। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের তো তা জানার প্রশ্নই আসে না। হতে পারে ৬ দফা ঘোষণার পর গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হতে পারে। কূটনৈতিক প্রতিবেদনের কথা আগে উল্লেখ করেছি, তা অনুসারে সেটিই স্বাভাবিক। তবে, রায় ও চৌধুরীর বিবরণে খানিকটা পার্থক্য আছে। দুজনই বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য তুলে ধরেছেন। এই দুজনের লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধু মোয়াজ্জেম হোসেনদের বিরত রাখেননি। মুজিব একটি বিকল্প পথ হিসেবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানকে ভেবে রেখেছিলেন। মোয়াজ্জেমের তাড়াহুড়ো তাঁর পছন্দ হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র ঘাঁটি দখল করার মতো অবস্থাও তাদের ছিল না। তাছাড়া লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম ও তাঁর অনুসারীরা সেনা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যা বঙ্গবন্ধুর ছিল অপছন্দ। সেজন্য তিনি তাদের থেকে সরে এসেছিলেন।
জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন মোয়াজ্জেম চৌধুরী। সিলেট থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২৯ এপ্রিল তিনি কনসাল ইনচার্জ ফ্রানসিস সি. প্রেসকটের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে ৬ দফা ও শেখ মুজিব নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
তাঁর মতে, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাই নেয়া হোক না কেন, স্বায়ত্তশাসন বিষয়টি মানুষকে এমনভাবে নাড়া দিয়েছে যে তা আর দমন করারথ নেই। মোয়াজ্জেম মনে করেন, খুব বেশি দেরি নয় যখন ভায়োলেন্স শুরু হবে এবং তা বাড়তে থাকবে। এই ভায়োলেন্সের সূত্রপাত হবে সংকীর্ণমনা বিহারি ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের কারণে। পশ্চিমা শিল্পপতিরাও বিহারিদের ব্যবহার করতে পারে। পকারণ, তারা পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। প্রাথমিকভাবে তারা ভায়োলেন্সের শুরু করবে হিন্দুদের বিরুদ্ধে। বাঙালিদের [মুসলমানদের] কোনো বিদ্বেষ নেই হিন্দুদের প্রতি কারণ তারা বহুদিন একত্রে বসবাস করছে। এবং এ পর্যায়ে যদি সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে তাহলে বাঙালি পুলিশরা ব্যাপকভাবে ৬ দফা আন্দোলনে যোগ দেবে।
জনাব চৌধুরীর মতে, খান এ সবুর, মোনায়েম খান ও প্রাদেশিক কিছু মন্ত্রী ছাড়া সংসদে মুসলিম লীগের কোনো সদস্য ৬ দফার বিরুদ্ধাচরণ করছে না। সবুর খান এ কারণে খুব ক্রুদ্ধ কিন্তু তার কী করার আছে। অনেকে প্রতিপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে যাতে সময়ে তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
মোয়াজ্জেমের মতে, বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের কারণে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি এবং সে দৃষ্টিকোণ থেকেই সব বিচার করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি নির্ভর করেন পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নরের ওপর যিনি কিছু ‘সামন্ত প্রভু’র সাহায্যে পুরো প্রদেশের দেখভাল করেন। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাহীন ও দুর্বল একজন গভর্নর নিয়োগ করেছেন। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দৃঢ়চেতা কোনো বাঙালিকে রাখতে চান না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কেন্দ্র যেসব মন্ত্রী নিয়োগ করা হয় তারাও দুর্বল এবং জনসমর্থনহীন অথবা নানা স্ক্যান্ডালে জড়িত। ফলে তারা প্রেসিডেন্টের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। কোনো মন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে তা বলার সাহস রাখেন না প্রেসিডেন্টকে।
স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এখন কেমন শক্তিশালী তা বোঝাতে একটি উদাহরণ দিলেন মোয়াজ্জেম। বিরোধী সব নেতা গিয়েছিলেন গভর্নর মোনায়েম খানের কাছে কয়েক সপ্তাহ আগে। তাদের বক্তব্য ছিল, তিনি যদি শেখ মুজিব বা অন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের জেলে পোরেন বা অন্য কোনো বিরোধী নেতা বা সংবাদপত্রের প্রতি এই আচরণ করেন তাহলে বিরোধী পক্ষের সবাই শেখ মুজিবকে সমর্থন করবেন। গভর্নর বলেছিলেন, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হবে না এবং বিরোধী দল ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে নির্যাতনমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। সে কারণে মুজিবকে কয়েক জায়গায় গ্রেপ্তার করায় বিরোধী নেতারা অবাক হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ বাদে অন্য বিরোধীদলীয় নেতারা ফের দেখা করতে গিয়েছিলেন মোনায়েম খানের সঙ্গে। মোনায়েম খান বিব্রত হয়ে জানালেন, মুজিব কিছু রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন তবে তাঁর ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়ার অনুসরণ করা হবে। মনে হয়, ময়মনসিংহ থেকে মুজিব যে দ্রুত ছাড়া পেলেন তার কারণ হয়তো গভর্নরের হস্তক্ষেপ।
মোয়াজ্জেম আরো জানালেন, এটি খুব দুঃখজনক যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার লাখ লাখ ডলার সাহায্য দিচ্ছে আইয়ুবকে। যুক্তরাষ্ট্র কি বোঝে না যে আইয়ুব কমিউনিস্ট চীনকেই মিত্র করতে চান। ভুট্টো বলেছে, ‘চীন ছিল বন্ধু, আমেরিকা ছিল মিত্র’। “In effect Bhutto was making fun of the United States by pretending to be a friend.” চৌধুরী বলেন, সরাসরি শেখ মুজিবকে ১ কোটি ডলার দিলে বোধহয় ভালো হতো। তাহলে রাতারাতি যুক্তরাষ্ট্র পেত কমিউনিস্ট বিরোধী, পশ্চিমাভিমুখী বন্ধুত্বপূর্ণ একটি দেশ। কিন্তু আমেরিকা লাখ লাখ ডলার ঢালছে পশ্চিম পাকিস্তানে যারা ক্রমেই চীনের ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে। আর ১ কোটি ডলার মোনায়েম খানকে দিলে তিনি “Would line him up with other autonomist” যদিও গভর্নর নীতিহীন ও ভ্রষ্ট, তিনিও জানেন স্রোত বইছে কোনদিকে।
মুজিব ও অন্য নেতাদের গ্রেপ্তারের পর পিন্ডি থেকে যে টেলিগ্রাম পাঠানো হয় ১২ মে, তাতে বলা হয়, এখন পরিষ্কার যে সরকার দমনের পথ বেছে নিয়েছে।
একই সময় ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশন [১৮.০৫.১৯৬৬] থেকে যে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে তাতে প্রশ্ন হয়েছে মূল প্রশ্ন পূর্ব পাকিস্তান কি এখন শান্ত না অশান্ত? তারা জানাচ্ছেন তারা এখন রংপুর দিনাজপুরের শান্ত বুনো জায়গায় ঘুরেছেন, তখন উন্নত জায়গাগুলোতে অনেক ঘটনা ঘটেছে। শেখ মুজিবসহ অন্য রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, তিনি অসুস্থ। অধ্যাপক মাহমুদের ঘটনায় কেন পাঁচজন সিনিয়র শিক্ষক বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছেন এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই পাঁচজন শিক্ষকের কাছে কৈফিয়ত দাবি করেছে। একটি বাঙালি ছেলেকে একটি মেমন মেয়ে বিয়ে করতে চাওয়ায় তার পরিবার বাধা দেয়। ফলে বাঙালি মেমন দাঙ্গা বেঁধে যায়। এরপর ইসমাইলিয়াদের পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যার ফলাফল শুভ হবে না। তবে মুজিবের জন্য জেলে ভিড় হয়নি। প্রতিবাদ সভাগুলোও ম্লান; পত্রিকাগুলো সরকারের কঠোর ব্যবস্থার সমালোচনা না করে আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করছে। এক কথায়, পরিস্থিতি এখন শান্ত। তবে, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম। শহর ও গ্রামে প্রতিক্রিয়া ভিন্ন। “Developing urban and industrial areas in a largely rural economy do frequently produce political movements.” সে কারণে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় অসন্তোষ থাকতে পারে। উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চল শান্ত। তবে সিলেট ও নোয়াখালীর কথা বলা যায় না।
প্রথম প্রকাশ: ভোরের কাগজ, জুন ৭, ২০২০
Add Comment